প্রধানমন্ত্রীর আশ্রয়ণ প্রকল্প এবং বিতর্কের অপচেষ্টা ❑ জিয়াউদ্দীন আহমেদ
প্রধানমন্ত্রীর আশ্রয়ণ প্রকল্প এবং বিতর্কের অপচেষ্টা
জিয়াউদ্দীন আহমেদ
❑
ভূমিহীন, আশ্রয়হীন, নি:স্ব পরিবারগুলোকে প্রধানমন্ত্রীর দেয়া ঘরগুলোর ভগ্নদশা বিভিন্ন মিডিয়া ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক প্রচার পাচ্ছে।দুই শতাংশ জমিসহ দুই কক্ষবিশিষ্ট আধাপাকা বাড়ির নির্মাণ নিয়ে বিভিন্ন অনিয়ম ও অবহেলার অভিযোগ উঠেছে।প্রধানমন্ত্রীর এমন একটি মানবিক কাজ কলঙ্কিত করার পশ্চাতের কারণগুলোর অনুসন্ধানে নেমেছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়।বিভিন্ন অনুসন্ধানে প্রতীয়মান হয়েছে যে, কিছু কিছু ক্ষেত্রে ঘর নির্মাণের নীতিমালা মানা হয়নি, কোথাও কোথাও নির্ধারিত কমিটিকে এড়িয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ঘর নির্মাণের সকল দায়িত্ব এককভাবে পালন করেছেন, কোথাও কোথাও ভূমির মালিকেরাও ঘর বরাদ্দ পেয়েছে, নিম্নমানের নির্মাণ সামগ্রী ব্যবহারের কারণে ঘরের মেঝে ও দেয়ালে ফাটল ধরেছে বা দেয়াল ধ্বসে পড়েছে, পিলার ভেঙ্গে গেছে, নিচু এলাকায় ঘর নির্মাণ করায় সামান্য বৃষ্টিতেই প্রকল্প এলাকা পানিতে ডুবে গেছে।
বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্যোগে ১৯৯৭ সনে ‘আশ্রয়ণ প্রকল্প’ গ্রহণ করা হয়।এই প্রকল্পের মাধ্যমে অদ্যাবধি প্রায় ৩ লক্ষ ভূমিহীন, গৃহহীন, অসহায় ও ছিন্নমূল পরিবারকে পুনর্বাসন করা হয়েছে; প্রায় ২ লক্ষ ৭৫ হাজার লোককে উপার্জন-উপযোগী পেশার উপর প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছে, প্রায় দেড় লক্ষ পরিবারকে ঋণ প্রদান করা হয়েছে। প্রকল্প এলাকায় বৃক্ষ রোপন করা হয়েছে, নির্মিত ঘর ও প্রকল্প এলাকায় বিদ্যুৎ সংযোগ দেয়া হয়েছে, সুপেয় পানি ও স্যানিটেশনের ব্যবস্থা করা রয়েছে।এছাড়াও সেনাবাহিনীর তত্ত্ববধানে মুজিব বর্ষ উপলক্ষে ব্যারাক নির্মাণ করে প্রায় ৫০ হাজার পরিবারকে ব্যারাকে পুনর্বাসন করা হয়েছে।পুনর্বাসিত পরিবার সমূহের জন্য সম্ভব হলে কমিউনিটি সেন্টার, মসজিদ, কবরস্থান, পুকুর ও গবাদি পশু প্রতিপালনের জন্য জমির ব্যবস্থা করা হয়েছে।খাসজমি, দান করা জমি, ক্রীত জমির উপর আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘরগুলো নির্মাণ করা হচ্ছে।
দুই রুমের আধা-পাকা প্রতিটি ঘরের নির্মাণ ব্যয় ধরা হয়েছে ১ লক্ষ ৭১ হাজার টাকা; নির্মাণ সামগ্রী পরিবহনের জন্য এর অতিরিক্ত ৪ হাজার দেয়া হয়।উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি টেন্ডার প্রক্রিয়া ছাড়াই নির্ধারিত জমিতে ঘর বা ব্যারাক নির্মাণ করে থাকে।এই কমিটিতে রয়েছে উপজেলা নির্বাহী অফিসার, সহকারী কমিশনার ভূমি, উপজেলা প্রকৌশলী এলজিইডি, সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা।প্রতিটি জেলার স্থানীয় প্রশাসনের সহায়তা নিয়ে অনুমোদিত নীতিমালা অনুসরণপূর্বক ভূমিহীন এবং গৃহহীন ব্যক্তিদের একটা তালিকা তৈরি করা হয়; ঘর প্রাপ্তির ক্ষেত্রে নীতিমালা অনুযায়ী বিধবা, প্রতিবন্ধী, অসহায় ও বয়স্কের অগ্রাধিকার দেয়া হয়।এছাড়াও পুনর্বাসনের পর প্রতিটি পরিবারকে ৩ মাস মেয়াদী ভিজিএফ সুবিধা প্রদান করা হয়।
মুজিববর্ষ উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চিন্তা প্রসূত এই উদ্যোগটি প্রচুর প্রশংসা পেয়েছে।ক্রমান্বয়ে সব ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবারকে আবাসন সুবিধার আওতায় আনার পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের।এছাড়া পুনর্বাসন করার পর তাদের বিনা জামানতে ক্ষুদ্র ঋণ প্রদান এবং প্রশিক্ষণের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহে সক্ষম করে তোলার ব্যবস্থা নেয়ারও কথা।কারণ যাদের পুনর্বাসন করা হচ্ছে তাদের যদি ঐ এলাকাতে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা না হয় তাহলে পুনর্বাসিত পরিবারের অধিকাংশ কিছুদিন পর গৃহ ত্যাগ করে শহরের দিকে পাড়ি দেবে।খাবারের ব্যবস্থা না থাকলে থাকার আশ্রয়ও গৌণ হয়ে যায়।যেখানে কাজ নেই সেখানে খেটে খাওয়া মানুষগুলো থাকতে চায় না।কর্মহীন মানুষেরা শহরে পাড়ি দেয়ার প্রধান কারণই হচ্ছে কাজ।শহরের মানুষের হাতে নগদ টাকা থাকে, হাত পাতলে কমপক্ষে ভিক্ষা পাওয়া যায়।
আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘরগুলো নির্মাণের দায়িত্ব স্থানীয় আমলাদের উপর ন্যাস্ত করায় জনপ্রতিনিধিরা নাখোশ।প্রধানমন্ত্রী সম্ভবত তাঁর এই কাজে সাংসদদের জড়িত করতে চাননি।বুদ্ধিজীবীরা বলে থাকেন, সাংসদদের কাজ শুধু আইন পাস করা, স্থানীয় উন্নয়নমূলক কাজে তাদের সংশিষ্ট করা হলে দুর্নীতি বাড়বে।কিন্তু আমলারাও দুর্নীতি করে; পর্দাকাণ্ড, বালিশ কাণ্ড ইত্যাদি কাণ্ডের সংঘটক কিন্তু আমলা, খিচুড়ি রান্না শেখার জন্য বিদেশ ভ্রমনের প্রস্তাব আসে আমলাদের কাছ থেকেই।বিগত দুই বছরে বিনা প্রয়োজনে বিদেশ ভ্রমণ না থাকায় দেশের অনেকগুলো টাকা বেঁচে গেছে।আমলা শুধু যুগ্মসচিব, অতিরিক্ত সচিব বা সচিব নন, সরকারের একজন পিয়নও আমলা।কথিত অভিযোগ হচ্ছে, কানাডার ‘বেগমপাড়া’ গড়ে উঠেছে দুর্নীতিবাজ আমলাদের অবৈধ টাকায়।ঢাকা শহরে বিত্তবৈভবের জৌলুশ আমলাদের কম নেই, রাজনীতিবিদদের চেয়ে বরং বেশী।
প্রধানমন্ত্রীর এই প্রকল্পে খুব বেশী দুর্নীতি হয়েছে বলে মনে হয় না।দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট সেমিপাকা প্রতি ঘরের জন্য ব্যয় প্রাক্কলন করা হয়েছে ১ লক্ষ ৭১ হাজার টাকা।দুইটি কক্ষ, রান্নাঘর, টয়লেট বারান্দাসহ একটা ঘর নির্মাণের জন্য এই বরাদ্দ পর্যাপ্ত বলে মনে হয় না।তদারকির ব্যয় ১৫% কম ধরা হলেও ঠিকাদার তার লাভ উঠিয়ে নেবে।অন্যদিকে শুধু সততা আর নিষ্ঠা দিয়ে কাজ হয় না, অকর্মক সৎ লোকগুলো দুর্নীতিবাজ কর্মঠ লোকের চেয়েও খারাপ।জবাবদিহিতা ও মনিটরিং নিশ্চিত করার সামর্থও অকর্মক লোকগুলোর নেই।মাছি মারা কেরানির মতো উপরের আদেশ-নির্দেশ পালনে দাসানুদাস মনোবৃত্তির কারণে ঘর নির্মাণে সীমিত বরাদ্দে উদ্ভুত সমস্যাগুলোও কারো নজরে আনার সাহস করে না তারা।নিম্ন এলাকায় খাস জমিতে ঘর করতে গিয়ে বন্যার উচ্চতা পরিমাপ করা হয়নি; কোথাও বর্ষায় জমি ধ্বসে যাওয়ার সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়নি, কোথাও এপ্রোচ রোডের কথা ভাবা হয়নি।অল্প টাকায় ঘর করতে গিয়ে ঘরের ভিত শক্ত করা সম্ভব হয়নি, বর্ষায় মাটি সরে যাওয়ার সাথে সাথে নির্মিত ঘর ধ্বসে পড়েছে, ঘরের মেঝে ও দেয়ালে ফাটলের সৃষ্টি হয়েছে।ঠিকাদার তার লাভ উঠিয়ে নেয়ার তাগিদে হয়তো অসদুপায় অবলম্বন করতে বাধ্য হয়েছে, সিমেন্ট কম দিয়ে বালি বেশী ব্যবহার করেছে।
গৃহহীনদের একটি আস্তানা গড়ে দেয়ার ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর এই মহতী উদ্যোগ সর্বমহলে প্রশংসিত হয়েছে।নতুন বাড়ি পেয়ে আশ্রয়হীন লোকগুলোও যারপরনাই খুশী হয়েছে, প্রধানমন্ত্রীর জন্য দুই হাত তুলে তাদের দোয়া করতেও দেখেছি।এমন একটি আলিশান ঘরে বসবাসের কথা তারা হয়তো স্বপ্নেও ভাবেনি।এই ঘরে উঠে তারা এখন রাতে নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারছে, সন্তানদের জন্য একটি ঘর রেখে যাওয়ার তৃপ্তি খুঁজে পেয়েছে।প্রকল্প বাস্তবায়নে বাস্তব সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে টেকসই ঘর সকল আশ্রয়হীন পরিবারকে দেয়া সম্পন্ন হলে বাংলাদেশের উন্নয়ন প্রচেষ্টার নিষ্কলুষ স্বাক্ষর দৃশ্যমান হবে।টেকসই ও মানসম্মত ঘর নির্মাণ নিশ্চিত করতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে নিয়মিত তদারকি করা হয়েছে বিধায় প্রধানমন্ত্রী তাঁর কার্যালয়ের সংশ্লিষ্টদের প্রশংসাও করেছেন,- প্রশংসার অংশীদার হলেন যারা তারা কিন্তু আজ আর দায় নিচ্ছেন না, আজ তারা অন্যের অনিয়মের পরিদর্শক ও তদন্ত কর্মকর্তা।
❑
লেখক
নির্বাহী পরিচালক,
বাংলাদেশ ব্যাংকে
ও
ব্যবস্থাপনা পরিচালক
সিকিউরিটি প্রিন্টিং কর্পোরেশনের(সাবেক)
ahmedzeauddin0@gmail.com
No comments