Header Ads

ভালোবাসার অনেক রঙ ❑ মমতাজ পারভীন


ভালোবাসার অনেক রঙ

মমতাজ পারভীন

শৈশব থেকেই শুভ্র আর নীলা খুব ভালো বন্ধু। দু'জনে সময় পেলেই কেয়া বনের ঝোপের ভিতর বর বউ খেলতো। নীলা পরতো টুকটুকে লাল শাড়ি আর শুভ্র পাঞ্জাবী।একসাথে স্কুলে যেতো, সারাদিন চলতো দু'জনের খুনসুটি। কখনো মতের অমিল হলে নীলার পিঠে পড়তো ধুমধুম কিল।নীলা ছোট বেলা থেকেই চাপা স্বভাবের। মার খেয়ে কাউকে বলতোনা,শুধু শুভ্রর সাথে অভিমান করে থাকতো।কিন্তু শুভ্র ওকে না দেখে থাকতে পারতোনা। তাই নানা কথা বলে ওর মান ভাঙাতে চেষ্টা করতো।এমনই করে বড় হতে লাগলো দু'জন। স্কুল ছাড়িয়ে কলেজে পা দিলো।মনের অজান্তে কখন যে ওদের বন্ধুত্ব ভালোবাসায় রূপ নিলো কেউ জানেনা। নীলা জন্মের পরই মা-বাবাকে হারিয়ে মামা-মামীর কাছে মানুষ। মামা মামুন সাহেব নিজের সন্তানের মতোই লালন-পালন করেছেন নীলাকে।কখনও মা-বাবার অভাব বুঝতে দেননি। নীলাদের বাড়ির পরে রাস্তা,তার পাশেই ছিলো শুভ্রদের দো'তলা বাড়ি।দুই পরিবারের মধ্যে হৃদ্যতা ছিলো বেশ।এমনি করে খুব সুন্দর দিন কাটছিলো দু'জনের।কলেজ শেষ করে এবার ভার্সিটিতে যাবার পালা। হঠাৎ নীলার মামাতো বোন বর্ষার বিয়ে ঠিক হলো। খান্দানী বংশ, ছেলে সুদর্শন, ভালো চাকুরী করে। দু'পক্ষের মধ্যে পাকা কথা হলো,বিয়ের সমস্ত প্রস্তুতি শেষ। কিন্তু বিয়ের দু,দিন আগে বর্ষার পড়ার টেবিলে পাওয়া গেল একটা চিরকুট। তাতে লেখা-
মা,
ভার্সিটির এক ছেলেকে আমার সমস্ত সত্তা দিয়ে ভালোবাসি।তাই বিয়ে করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।জানি, বাবা কোনদিন মেনে নিবেনা। তাই পালালাম। পারলে ক্ষমা করো।
মামুন সাহেবের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়লো।
সারা বাড়িতে যেন নেমে এলো শোকের ছায়া।সেদিন মামুন সাহেবের সাথে পাত্র পক্ষের কী কথা হলো জানিনা।বিষন্ন মনে তিনি ও তার স্ত্রী এলেন নীলার ঘরে। মামা-মামীর মুখচ্ছবি দেখে নীলার অন্তর-আত্মা হুহু করে কেঁদে উঠলো।মামুন সাহেব নীলার হাত দু'টি চেপে ধরে বললেন -মা'রে তুই পারবিনা, আমাকে এ অসম্মানের হাত থেকে বাঁচাতে? কোনকিছু বুঝে উঠার আগেই নীলা বললো,আমাকে কী করতে হবে বলো,মামা।মামী বললেন, বিয়েটা তোকেই করতে হবে, মা! নীলার সমস্ত রক্ত কনিকা যেন জমাট বেঁধে হিম হয়ে গেলো।তবুও মামার মুখপানে চেয়ে কিছুই বলতে পারলোনা।
আজ নীলার গায়ে হলুদ। নানা রঙের নিয়নের আলোয় ঝলমল করছে সারা বাড়ি। আত্মীয় স্বজনদের আনন্দ ফূর্তিতে মুখরিত সারাক্ষণ। কিন্তু আনন্দ নেই শুধু নীলার মনে, সেখানে জমে আছে এক খন্ড ধূসর মেঘ।নীলার রুমে ওর কাজিন আর বান্ধবীরা ওকে সাজিয়ে গুছিয়ে প্রস্তুত করছে গায়ে হলুদের মঞ্চে যাওয়ার জন্য। হঠাৎ ভীড় ঠেলে শুভ্র দৌড়ে এসে দাড়ালো নীলার সামনে। সবাই চেঁচিয়ে উঠলো,একি কান্ড!এতোগুলো মেয়েদের ভিতরে আপনি এখানে ঢুকে পড়লেন কেন?নীলার কাজিন বললো,কমন সেন্স বলতে কিছু নেই! নীলা সবাইকে থামিয়ে দিয়ে বললো,এভাবে বলছিস কেন? একজন হেসে বললো--এই নীলা,"ও"তোর জন্যই এখানে এসেছে কিনা বলতো!শুভ্র বেরিয়ে গেলে নীলা সবাইকে পাঁচ মিনিটের কথা বলে বাইরে গেলো। ও জানে শুভ্র কোথায় আছে। বাড়ির পিছনের সেই স্মৃতি মাখা কেয়া বনে দাড়িয়ে শুভ্র নীলার হাত দু'টি চেপে ধরে বললো,তোকে ছাড়া আমি যে নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে মারা যাচ্ছি,নীলা। একটি দিন ও আমি তোকে ছাড়া ভাবতে পারিনা।চল্ দু'জন কোথাও পালিয়ে যাই।নীলা ধীরে ধীরে হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে বলতে লাগলো--তোর সাথে নিরুদ্দেশ যাত্রায় ও আমার কোন ভয় নেই। কিন্তু পিতৃতুল্য মামার সাথে বর্ষা আপুর মতো এমন প্রতারণা আমি করতে পারবোনা।তাইতো আমার স্বর্গীয় প্রেমকে গলা টিপে হত্যা করে দূরে চলে যাচ্ছি। আমাকে ক্ষমা করিস শুভ্র। তুই ভেঙে পরিস না,জীবনটাকে সুন্দর করে গড়ে নে,আমি বন্ধু হয়ে তোর পাশে থাকবো আজীবন।বলতে বলতে নীলার চোখ দুটি ঝাপসা হয়ে এলো। কী যেন ভেবে শুভ্র বললো, আমার একটা শেষ অনুরোধ রাখবি? প্লিজ,বিয়েতে লাল শাড়ি পরিস না,আমি সইতে পারবোনা। চোখের পানি লুকাতে নীলা দ্রুত চলে এলো ঘরে।এসে ওর মামীকে গলা জড়িয়ে ধরে বললো, আমাকে একটা নীল শাড়ি কিনে দাও। সে কি রে!বিয়েতে কেউ নীল শাড়ি পরে না-কি? আমি পরবো।একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে নীলা মনে মনে বললো-যার সারা অঙ্গ নীল কষ্টে ছাওয়া, সে-তো নীল শাড়িই পরবে। লাল,নীল,হলুদ জোৎস্নায় উদ্ভাসিত সে রাতে গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান খুব জমে উঠেছে। ওর কাজিনরা সবাই গান জুড়ে দিলো---
"আজ জোছনা রাতে সবাই গেছে বনে
বসন্তের এই মাতাল সমীরণে------"
বিয়ে বাড়ির কোলাহল আর গানের প্রতিটি কলি বিষাক্ত তীরের মতো বিঁধতে লাগলো শুভ্র'র বুকে।পরেরদিন নীলা চলে গেলো শ্বশুরবাড়ি। যাবার সময় ওর ব্যথাতুর দুটি চোখ বার-বার খুঁজতে লাগলো সেই চিরচেনা মুখ।কিন্তু কোথাও তার দেখা নেই।
আজ নীলার বাসর রাত।শুভ্র এক মুহূর্তের জন্য ও ঘুমাতে পারলোনা। এ্যালবাম খুলে নীলার ছবিগুলো অপলক দৃষ্টিতে দেখতে লাগলো।তারপর ছাঁদে চলো গেলো। সেই নির্জন রাতে একাকী বসে ভাবতে লাগলো---প্রেম জীবনকে দেয় ঐশ্বর্য, মৃত্যুকে দেয় মহিমা।কিন্তু প্রবঞ্চিতকে দেয় কী? তাকে দেয় দাহ।যে আগুন আলো দেয়না, অথচ দহন করে, সেই দীপ্তিহীন অগ্নির নির্দয় দহনে পলে পলে দ্বগ্ধ হওয়ার কোন স্বার্থকতা নেই। আছে শুধু নিরবে সহ্য করার অব্যক্ত ব্যথা।শুভ্র আর ভাবতে পারলোনা, দু'হাতে চোখ ঢেকে ছাঁদ থেকে লাফিয়ে পড়লো।
সকালে বারান্দায় বসে কপি খেতে খেতে খবরের কাগজ পড়ছিলো নীলার স্বামী। হঠাৎ নীলাকে ডেকে পত্রিকার একটা ছবি দেখিয়ে বললো, দেখোতো!তোমাদের পাশের বাড়ির ঐ ছেলেটা না?প্রেম ঘটিত কারণে আত্মহত্যা করেছে। হয়তো তোমার প্রেমেই পড়েছিলো।কিন্তু বোকা ছেলে আত্মহত্যা করতে গেলো কেন?
আজ শুভ্র নেই। কিন্তু নীলার সমস্ত সত্তা জুড়ে রয়েছে শুধুই ওর স্মৃতি। বর্ষা সমস্ত বন্ধন ছিন্ন করে তার ভালোবাসাকে পূর্ণতা দিয়েছে। নীলা তার ভালোবাসা বিসর্জন দিয়েছে মামার স্নেহ আর মমতার বন্ধনে।শুভ্র
মরে প্রমাণ করেছে তার প্রেমের গভীরতা। আর নীলার স্বামী! সারাজীবন ঘর করছে একটা জীবন্ত লাশের সাথে,যার মনের ছোঁয়া পায়নি কোনদিন। তাই তো ভালোবাসার অনেক রঙ।

No comments

Powered by Blogger.