অবন্তিকা ❑ উপন্যাস ❑ কিশোর পণ্ডিত ❑ পর্ব ০৫
উপন্যাস
অবন্তিকা
কিশোর
পণ্ডিত
বিকাল ৫ টা বাজতেই একটা ফোন এল অবন্তিকার । কলের উত্তরে সে প্রশ্ন করল কখন ? আধঘন্টার মধ্যেই । আচ্ছা আসছি বলেই সে পার্থের ঘরে চলে গেল বলল চলুন যেখানে যেতে চেয়েছি সময় হয়ে গেছে রেডি হয়ে নিন । বলেই সে তার ঘরে চলে গিয়ে পােশাক বদল করতে লাগল । তাকে খুব খুশি খুশি লাগল । কোন ড্রেস পরবে সে । ভেবে ঠিক করল নীলটা । নীল রঙের শাড়ী - ব্লাউজ , নীল টিপ , ঠোটের লিপস্টিক নীল তার গায়ে সব নীল রঙের সাজে সাজিয়ে নিল নিজেকে । এ অবসরে পার্থও খুব সাজলাে । বেরিয়ে পড়ল দুজনে নীল রঙের গাড়ীতে । গাড়ী উত্তরার দিকে চললো । সােজা এয়ার পাের্টের দিকে । এয়ার পাের্টে এসে গাড়ী থামালাে । দুজনে নেমে গেল ভিআইপি লাউঞ্জের দিকে । অবন্তি জেনে নিল লন্ডনের ফ্লাইট আসতে আর কত দেরি । হয়ত একটু সময় লাগতে পারে । তাই তারা দুজনে কিছুক্ষণ বসল । নীল টিপ আর নীল শাড়ীতে সুন্দর মানিয়েছে অবন্তীকাকে । তবুও তার যদি বলার অনুমতি থাকতাে সে তাকে সবুজ টিপ পড়তে বলতাে । ভাবলাে পার্থ । কি সুন্দর দেখাচ্ছে অবন্তিকাকে গলায় চিক আর নীল সুতার মাঝে মঙ্গল সূত্র বাহারী মানিয়েছে তাকে । আহা সে যদি আমার হত । সে যদি নিজে ইচ্ছে করেই বলতাে আমি তােমাকে ভালবাসি । সে যদি আমাকে ধমকিয়ে বলত যা মনে আছে যা তােমার ইচ্ছে যা তুমি আমাকে বলতে চাও সাহস করে বলে ফেল । ভালবাসায় ভয় নেই । সে যদি আমার হাতে ধরে কাছে নিয়ে বসতাে । কি সুন্দর না হতাে তাহলে । ভাবল পার্থ । সে মনে মনে চিন্তা করল একাকি যখন হয়েছি এমন সুযােগ যখন পেয়েছি আজ আর ভয় নেই । কবিতাটা তাকে উপহার দিয়ে বলব আমি তােমাকে ভালবাসি । পকেট থেকে কবিতাটা বের করে সে ডান হাতের মুঠোয় নিল এবং অবন্তির সামনে গেল । তখন অবন্তি উল্টো মুখ করে রান ওয়ের দিকে তাকিয়ে আছে । পার্থ বলল শুনুন । শুনুন বলতেই বিমান নেমে গেল । অবন্তি , পার্থর কথা না শুনে সামনে রান ওয়ের দিকে অগ্রসর হল । অবন্তির হাতে রজনীগন্ধার স্টিক । ফুল দেখে পার্থ তাকে জিজ্ঞাসা করতে চেয়েছিল কে আসবে । হয়তাে তাদের কোন নিকট আত্মীয় আসবে ভেবে ছিল পার্থ । তাই আর জিজ্ঞাসা করেনি । আর যে আসবে সে তাে এখানে কাছে আসবে । তাই জিজ্ঞাসা করেনি সে । সে আসল দেখা হল অবন্তিকার সাথে । কথা হল তাদের । কেমন আছাে নীল কমল ? বিমান থেকে নেমে আসা ভদ্রলােক জিজ্ঞাসিল অবন্তিকে । কেমন আছি তুমি কি বুঝ না সুকমল । বলেই দুজনে খুব খুশির হাসি হেসে নিল । পরিচয় হল পার্থের সাথে । অবন্তিই পরিচয় করিয়ে দিল । ওনি আমার বন্ধু । সুকমল জিজ্ঞাসিল কেমন বন্ধু ? তােমার মত নয় বলল অবন্তি । অবন্তি পার্থকে তার সাথে ভাল করে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলল ও আমার সুকমল । ওই আমার সব । ওকে আমি ভালবাসি । পছন্দ হয়েছে আপনার সুকমলকে ? বলুনতাে আমার পছন্দ কেমন ? ঢের পছন্দ আপনার নইলে কি আপনি নীল কমল । হ্যাঁ ,নীল কমল রামের ১০৮ টা নীল কমলের শেষটা আপনি । ভদ্রলােকের সাথে হ্যান্ডশেক করল পার্থ । ভদ্রলােক ইংরেজিতে যেন কী বললেন । সেদিকে লক্ষ্য করল না পার্থ । তার যেন কেবল কাঁদতে ইচ্ছে করল । বুক ফেটে যাচ্ছে । নিশ্বাস যেন বন্ধ হয়ে আসছে । এই ছিল তার ভাগ্যে । যাকে নিজের করবে বলে ভেবেছে সে আগে থেকেই পরের হয়ে আছে ।
বিতৃষ্ণায় আর উৎকণ্ঠায় মানুষের মাথা গরম হয়ে আসে । কিন্তু পার্থর তা হল না । অনেক কষ্টে সামলিয়ে নিল নিজেকে । ভাবল মানুষের কষ্ট কোথায় ? অনেক কিছুই না পেয়ে মানুষ কষ্ট পায় । টাকা না পেয়ে মানুষ কষ্ট পায় ।চাকুরী না পেয়ে মানুষ কষ্ট পায় । ধন সম্পদ না পেয়ে বা হারালে মানুষ কষ্ট পায় । কোন বধু পূজার শাড়ী না পেয়ে কষ্ট পায় । কোন নেশাখোর তার ড্রাগ না পেয়ে কষ্ট পায় । মা কষ্ট পায় মাতৃত্ব না পেয়ে । পিতা কষ্ট পায় নিঃসন্তান হলে । ভ্রমর কষ্ট পায় মধু না পেয়ে । মৃত্যু যন্ত্রনার চেয়েও যেন তার কষ্ট হল এ বিচ্ছেদে । উপর দিকে চোখ তুলে পার্থ বলল এ কেমন খেলা খেললে হে বিধাতা , তােমার খেলা বুঝা বর ভার । পার্থের আর এখানে থাকতে ভাল লাগল না । সে বলল ৬ টার সময় আমার এক জরুরী কাজ আছে । আপনারা কথা বলুন আমি একটু আসি , বলে সে ঐ স্থান ত্যাগ করল । পার্থ চলে গেলে সুকমল বলল চল বাইরে যাই । তাদের সাথে অনেক কথা হল । সুকমল বলল ড্যাডি অপেক্ষায় আছে ড্যাডির সাথে কথা বলেই তােমায় ফোন করব । তুমি চলে এসাে ,বলে সুকমল তার পিসিমার সাথে গাড়ীতে উঠল ।
রাধেশ্যাম চৌধুরীর একমাত্র পুত্র সুকমল চৌধুরী । ডাক্তারী শেষ করে F.R.C.S করতে গিয়েছিল লন্ডনে । রাধেশ্যাম ও প্রকাশ কুমার চৌধুরী বন্ধু । রাধেশ্যাম আগে থেকেই চেয়েছিলেন প্রকাশের একমাত্র কন্যা অবন্তিকার সাথে তার একমাত্র পুত্রের বিবাহ । কিন্তু প্রকাশ চৌধুরীর সুকমলকে তেমন পছন্দ হত না সে চেয়েছিল অন্য কারও হাতে তার একমাত্র মেয়েকে সম্প্রদান করতে । কিন্তু কিছুদিন আগে তিনি জানতে পেরেছেন অবন্তি আর সুকমলের ভালবাসার কথা । তিনি চেষ্টাও করেছিলেন এ ভালবাসা ভাঙ্গতে কিন্তু অবন্তি তাতে গড় রাজি হওয়ায় তা হয়ে উঠেনি । রাধেশ্যাম একমাত্র ছেলেকে কাছে পেয়ে খুশীতে আত্মহারা হয়ে গেলেন । তিনি খুশীতে পি.কে রায় চৌধুরীকে টেলিফোন করে রাতে নিমন্ত্রণ করে দিলেন । সুকমলের টেলিফোনের আশায় অবন্তি বসেছিল । কিন্তু সুকমলের টেলিফোন আসল না । অফিস থেকে তার বাবা ফিরে এসে অবন্তিকে বলল সুকমলদের বাসায় নিমন্ত্রন হয়েছে যাবে না । যাব বলে খুশীতে প্রণাম করে নিল বাবাকে । কিন্তু তার বাবা যেতে রাজি হলাে না । বললেন তুমি তােমার মাকে নিয়ে যাও । অবন্তির মা অমন বড়লােকের ছেলের সাথে অবন্তির সম্পর্ক জানতে পেরে খুব খুশীই ছিলেন । তিনি বললেন চল আমরা দুজনেই যাই । অবন্তি তাতেও রাজি হয়ে গেল । প্রকাশ বাবু পার্থের কথা জানতে চাইলেন বললেন এত রাত হয়ে গেল ছেলেটা এখনাে আসছে না কেন ? অবন্তি বলল উনি বলেছেন উনার নাকি জরুরি কি কাজ আছে । আমার সাথেই ছিল । আচ্ছা দেখা যাবে তােমরা যাও । অবন্তি ও তার মা সুকমলদের বাসায় চলে গেল । আর তার বাবা পার্থের অপেক্ষায় বাসায় রইলেন ।
সে রাত কেটে গেল । সকাল হতেই প্রকাশ বাবু পার্থকে ডাকলেন । তাদের কাজের ছেলে কার্ত্তিক এসে বলল সে তাে কাল রাতে বাড়ী ফিরেনি বাবু । সে কি বাড়ী ফিরেনি ! তাহলে গেল কোথায় ? চিন্তায় পরে গেলেন প্রকাশ বাবু । এ অফিস ও অফিস বিভিন্ন অফিস পার্থের বন্ধুদের বিভিন্ন ঠিকানায় পরে বিভিন্ন হাসপাতালে খবর নিয়ে বাড়ীতে ফিরলেন তিনি । প্রকাশ বাবু যখন এত খোঁজাখুঁজি করতেছিলেন তখন পার্থ বিহারপুরের উদ্দেশ্যে ট্রেনে উঠেছে । যখন বাড়ীতে ফিরল তখন গােধুলি বেলা । মা যুথিকা ছেলেকে দেখে ভীষণ খুশি । তিনি খুশিতে ছেলের দিকে দৌড়ে আসলেন কিন্তু এ কি দশা হয়েছে ওর । তার যেন মনে হল ছেলের উপর দিয়ে কাল বৈশাখী ঝড় বয়ে গেছে । মা যুথিকা তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে নিলেন । কিন্তু অমন মলিন চেহারা ওশকো খুশকো চুল , চোখ দু'টি লাল কি হয়েছে পার্থের । মা বুঝলেন হয়ত কিছু হয়েছে কিন্তু কিছু জিজ্ঞাসা করলেন না । হাত মুখ ধুয়ে খেতে বসতে বললেন । হারানাে ব্যথায় ব্যথিত ভাঙ্গা হৃদয়ে অভুক্ত পার্থ খেতে বসল ঠিকই কিন্তু তার পেটে কিছুই গেল না । তাহলে কি ছেলের অসুখ করেছে । এভেবে যুথিকা রাতে নরহরি কবিরাজকে ডেকে নিয়ে আসলেন । কবিরাজ কোন অসুখের খোঁজ পেল না । কোন চিকিৎসা না দিয়ে সে চলে গেলাে ।
পরদিন বিকাল বেলা পার্থ তার সকল দুঃখের কথা তার মাকে জানালাে । তার মা সবশুনে দুঃখ পেলেন ঠিকই কিন্তু পরক্ষণেই কঠোর হলেন । বললেন আমি তােমাকে এজন্য তাে শহরে পাঠাইনি । তুমি আমার একমাত্র পুত্র অতি কষ্টের নীলমনি । তােমার দিকে চেয়ে আমরা বেঁচে আছি । তােমার উপার্জনেই আমরা বাঁচি । তােমার বলেই আমাদের বল । তাছাড়া তুমি একজন মুক্তিযােদ্ধার ছেলে । তােমার বাবা যে আশায় যুদ্ধে গিয়েছিল সে আশা এখনাে পুরণ হয়নি । এখনাে আমরা কষ্টে আছি । এখনাে অনেকেই অভুক্ত থাকে । বেকার আছে অনেকেই । দেশ বিরােধীরা দেশের রন্ধ্রে রন্ধে ঢুকে আছে । আমরা যা চেয়েছি তা কি আমরা পেয়েছি । নারীর ভালবাসায় না , দেশের ভালবাসায় নিজেকে উজার করে দাও । আমি চেয়েছিলাম লক্ষ ললনারা তােমায় ডাকবে কিন্তু তুমি সারা দেবে না । আর তুমিই ললনাদের খপ্পরে নিজেকে বিলীন করে দিতে চাইছ ? তােমার জন্য কি তারা বসে থাকবে ? তারা ঠিক অট্টালিকায় খুশীর আনন্দে ঘর করবে । তুমি কেন তাদের আশায় বসে থাকবে । না না পার্থ এটা তােমাকে মানায় না । শক্ত কর নিজেকে দেশের জন্য দশের জন্য কিছু কর । দেশ প্রেমিক হও। দেশের সেবা কর । দেশ থেকে অনেকেই অনেক পেয়েছে কিন্তু দেশকে তারা দিয়েছে কি ? তুমি কিছু দাও । তােমার অপেক্ষায় নতুন অবন্তিকারা । তুমি সব ভূলে যাও । চিনতে চাও আমাকে বুঝতে শিখ বাংলাদেশের মা'দের । তবেই তুমি আমার সন্তান । তবেই তুমি গ্রামের সন্তান । তবেই তুমি এ দেশের সন্তান । ধন্য হও তুমি ধন্য কর আমাকে । দুঃখ ধুয়ে ফেল । কষ্ট ভুলে যাও । যন্ত্রণা সরিয়ে দাও । তুমি ব্যথিত নও , ব্যথা তাদের দাও যারা তােমায় কষ্ট দেয় । তােমার কাছে আমার এই মিনতি ,এই আমার অনুরােধ ,এই আমার আদেশ এবং নির্দেশ ।
যুথিকা বাইরে কঠিন হলেন ঠিকই কিন্তু ভিতরে ভিতরে নরম রইলেন । মনে মনে শুধু ভাবলেন ,ভালবাসা ! ভালবাসা ! হায়রে ভালবাসা ! এ যেন এক নির্ভীক সত্য । এ যেন এক সত্যিকার কষ্ট । আবার এ যেন চির স্বর্গ সুখ । এর সমান সুখ নাই । এর সমান কষ্ট নাই । ভালবাসার জোর অনেক । যার টানে জাত যায় ধর্ম যায় । রাজার ছেলে ভিখেরী হয়ে যায় । রাজকুমারী রাজ প্রাসাদ ডিঙ্গায় । কি এই ভালবাসা ? কোথা থেকে আসে কি কঠিন এর রূপ । ভালবাসার স্রোতে সব ভেসে যায় । সব খসে যায় । সত্যিকার ভালবাসারই জয় হয় । এমনই হয়েছিল যুথিকার । সেও ভালবাসার টানে ঘর ছেড়েছিল । ত্যাজ্য হতে হয়েছিল তার স্বামীকে । আবার ভালবাসার টানে সব সহ্যও করেছে । তাদের ভালবাসায় সুখের চেয়ে দুঃখই গেছে বেশী । মনে আছে তার সুখের কথা মনে আছে তার দুঃখের কথা । যখন তাকে পায় নাই বিয়ের আগে কত সুখ না ছিল । মিলনের আগেই তার সুখ ছিল । মিলনের পরে তা হয় নাই । তাহলে ভালবাসার সুখ মিলনে না বিরহে । বিরহেই ভালবাসার প্রকৃত সুখ । বিরহেই ভালবাসা বেঁচে থাকে । কিন্তু কষ্ট অনেক । সে কষ্ট কি সইতে পারবে পার্থ । ভাবলেন যুথিকা । ভাবতে ভাবতে পার্থের কাছ থেকে দুরে সরে গেলেন ।
No comments