অবন্তিকা ❑ উপন্যাস ❑ কিশোর পণ্ডিত ❑ পর্ব_০৪
উপন্যাস
অবন্তিকা
কিশোর
পণ্ডিত
মানুষ মানুষকে পছন্দ করে কিনা তা জানি না । তবে মানুষের ব্যবহার , তার চরিত্র , সৌজন্যতাবােধ , ভালবাসা , স্নেহ , উদারতা , প্রেম ও মনুষ্যত্বকেই যে মানুষ ভালবাসে এ কথা চির সত্য । আর এই ভালবাসার সকল দিকগুলাে অবন্তিকার মধ্যে তার । সে তার সুব্যবহার দ্বারা আকৃষ্ট করেছে পার্থকে । তার চরিত্রে ফুল সম পবিত্রতা সৌজন্যতায় সম্পূর্ণ উদাসীন । ভালবাসায় যেন অজেয় । স্নেহ , মায়া - মমতা , উদারতায় পার্থকে বস্য করেছে । প্রেম ও মনুষ্যত্বে সে পার্থকে চির সঙ্গী করেছে । পার্থ শুধু তার অনুরাগের ছোঁয়া পেতে চায় । তার কাছে পাৰ্থ কি চায় বুঝে না । শুধু এটুকু বুঝে অবন্তি তার কাছে থাকলেই সে ধন্য । তার সাথে একটু কথা বললেই তুষ্ট । তার গায়ের একটু গন্ধ পেলেই পুলকিত । তার গভীর কালাে চোখে চেয়ে থাকলে সর্বকালের আনন্দ । পার্থ ঠিক করেছে সে অবন্তিকাকে আর আপনি বলে ডাকবে না । আপনি ভাবাটা তাকে কাছের বলে মনে হয় না । সে তুমি বলেই ডাকবে । এভেবে সে সাহস করে অবন্তির খোঁজে তার পড়ার ঘরে ঢুকল । গিয়ে দেখল ঘরটার মাঝেখানে একটা খাট । দক্ষিন দিকের জানালা ঘেষে তার পড়ার টেবিল । উত্তরে সােফা । পূর্ব পশ্চিমে নাম না জানা কত আসবাব পত্র । ঘরের দেয়ালে নানা রকম দৃশ্য টানানাে । মেঝে শ্বেত পাথর আটা । উত্তরের দেয়ালে আধুনিক ঘড়ি শােভা পাচ্ছে । ঘরে ঢুকতেই ঘরির কাটা ঢং করে বেজে উঠল । ন'বার শব্দ করল । বুঝা গেল ৯ টা বাজে । ঘরে সুবাস জড়ানাে গন্ধ । বুঝা গেল না এটা কি ঘরের গন্ধ না অবন্তির গায়ের । পায়ের মৃদু শব্দে অবন্তি পিছন ফিরে তাকাল । দেখল তার ঘরে পার্থ । সে কি ? আপনি ইতস্তত হয়ে বলল অবন্তি ।
কেন ঘরে আসতে মানা আছে নাকি ? না তা নেই । আপনি কখনো আসেননি তাে তাই । বললে এখন থেকে প্রত্যেক দিন আসব । মিলবে নাকি অনুমতি ? বা রে আসবেন , অনুমতি কিসের । মেয়েদের ঘরেতাে তাও আবার আপনার । বসতে বলবেন না ? পার্থর কিন্তু আপনি বলাটা যাচ্ছে না । সে শুধু ফুরসৎ খুঁজছে কখন কিভাবে তুমি সম্বোধন করা যায় । হ্যাঁ বসুন । আপনিও বসুন । অবন্তি পার্থ দুজনে সামনা সামনি বসল । পার্থ অবন্তির চোখপানে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল । অবন্তি যেন একটু লজ্জা পেল । সে চোখ সরিয়ে নিল । গ্রামের কথা বলুন । গ্রামের মানুষের গল্প গ্রামের বর্ণনা আমার খুব ভাল লাগে । পার্থ চেয়েছিল অবন্তির গল্পই আজ সে শুনবে । কিন্তু অবন্তি পাশ কাটিয়ে গেল । শেষে তাকেই গল্প করতে হল । পার্থ গাঁয়ের অনেক মানুষের সুখ - দুঃখের কাহিনী গল্প করল । পার্থের বন্ধু তীর্থের কথা । তীর্থের প্রেমের কথা । ভুবনেশ্বর ব্যানার্জীর ছােট মেয়ে তনুকে তীর্থের ভাল লাগে । কিন্তু ভাল লাগার কথাটা সে তনুকে বলতে পারে না । অনেক কষ্ট করেও সে তা পারল না । একদিন গ্রীষ্মকালের দুপুরে তাদের বাড়ী থেকে অন্য পাড়ায় মৃনালদের বাড়ী যাচ্ছিল তনু । পথে তীর্থের সাথে দেখা । তীর্থ তনুকে ডেকে বলল । শােন তনু । একটু দাঁড়াও । তােমার সাথে আমার একটি কথা আছে । তনু যেন তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে । তােমার সাথে আবার কিসের কথা । দুরে যাও । তীর্থর ভয়ে গা ঘেমে গেল । ভয়ে ভয়ে বলল শোনই না । অবন্তিকা তার গল্প শােনে যেন হেসে গলে গেল।হাসতে হাসতে বলল ,আপনি কখনাে কাউকে প্রেম নিবেদন করেন নি ? না কখনাে না । তবে ইচ্ছা আছে । সাহস পাচ্ছি না বলল পার্থ । তারপর ?তীর্থের কাহিনী বলুন ,বলল অবন্তিকা । পার্থর মন যেন একটু অশান্ত হল । অশান্ত মনেই তীর্থের গল্প বলে চলল । তারপর একদিন তীর্থ ঠিক করল চিঠিতে তার মনের কথা লিখে তনুকে দিবে । কথামত সব চিঠিতে লিখে একদিন ওর ছোটবোনকে দিয়ে তনুকে দিল। তনু চিঠি নিয়ে সব পড়ে চিঠি ছিঁড়ে ফেলল।এভাবে তীর্থ অনেক চেষ্টা করেও তনুর মন পেল না । সেই থেকে তীর্থের খাওয়া দাওয়া কমে গেল । শুধু তনুর চিন্তায় মগ্ন রইল । তার দেহ শােকাতে লাগল । দেহে অসুখ ধরল ।চোখ গর্তে ঢুকে গেল । এই ঘটনা কেউ জানত না। একদিন তনুই তার বান্ধবীর কাছে বলেছিল । আমরা তার বান্ধবীর কাছ থেকে জেনে তীর্থের নীরবতা আর মলীনতার কথা জানলাম । তার কষ্টের কথা জানলাম । আমরা চারজন তনুকে তীর্থের কথা খুব অনুরােধ করে বললাম । সে যে তনুর জন্য তিল তিল করে শেষ হয়ে যাচ্ছে তা বুঝালাম । সে শক্ত অসুখ বাঁধানাের আগে ওকে একবার দেখতে যেয়াে । তনু রাজী হয়ে গেল । একদিন সুর্যাস্তের আধ ঘন্টা আগে তনু তীর্থদের বাড়ী গেল এবং সে কেমন আছে জানতে চাইল । তীর্থ তাে তাকে দেখে খুব খুশী । আগে তাকে তুমি করে বলতাে । আজ বললাে তনু আপনি কেমন আছেন ? আমার কথা মনে পড়ল । মাঝখানে অবন্তি পার্থকে থামিয়ে বলল । আচ্ছা আপনি আমাকে আপনি বলে ডাকেন কেন । আমি তাে আপনার ছােট । তুমি করে বলতে পারেন না । পার্থ যেন যা চেয়েছিল সেই সন্দেশ মুখে পেল । ঠিক আছে আজ থেকে আপনাকে তুমি বলেই ডাকব । তােমাকেও কিন্তু আমাকে তুমি বলতে হবে । অবন্তি আবার পাশ কাটিয়ে বলল তারপর তনু কি করল ? তনু মনে মনে হাসল এবং বলল কাল আবার আসব । তীর্থ মনে মনে খুব খুশী হলাে । তনু তীর্থকে নিয়ে পরদিন বিকাল বেলায় গ্রামের প্রাইমারী স্কুলটার পুকুর ধারে অনেক সময় বসে তীর্থের অনেক কথা শুনল । তীর্থও তনুর অনেক কথা শুনল । একসময় তীর্থ তনুকে জিজ্ঞাসা করল আগে রাজি হলে না কেন ? বুঝিনি । কি বুঝনি ? ভালবাসা । ভালবাসা মানে কি ? বলল তীর্থ । তনু বলল বুঝি না । তবে এখন এটুকু বুঝি তােমাকে দেখলে আমার খুব আনন্দ লাগে । তােমার চোখে চাইতে খুশী লাগে । সাথে গল্প করতে মজা লাগে । তােমাকে নিয়ে কল্পনা করতে মনের মধ্যে শিহরণ জাগে । তােমাকে না দেখলে ভাল লাগে না । আমার তােমাকে নিয়ে শুধুই ইচ্ছে করে বেরিয়ে যেতে নির্জনে । যেখানে আমি আর তুমি ছাড়া কেউ নেই ।
অবন্তি বলল তনু তীর্থকে ভালবাসার মানে জিজ্ঞাসা করেনি । করেছে বলল ,পার্থ । জবাবে তীর্থ কি বলেছিল ? তীর্থ বলেছিল সেও ততটা বুঝে না তবে তার শুধুই তনুকে হারাবার ভয় । কখন যেন তনু দূর দেশে তাকে না বলে চলে যায় । কখন যেন নতুন কারাে সাথে পরিচয় হয় । সে পরিচয়ে যদি তার মন থেকে নির্বাসনে যায় । আবার কখনাে যদি তাকে বিসর্জন দিতে হয় । সে তনু চিরকাল থাকবে কি না । চিরকাল কইবে কিনা তার কথা । গল্প করতে করতে অনেক সময় পেরিয়ে গেল । অবন্তির চোখে ঘুম ঘুম ভাব বুঝল পার্থ । আজ থাক , অনেক রাত হয়ে গেছে । অবন্তি যেন তাই চেয়েছিল সে বলল, সেই ভাল আজ থাক ঘুমিয়ে পড়ুন গিয়ে । এক সময় অবন্তি পার্থকে বলল চলুন কালকে এক জায়গায় নিয়ে যাব আপনাকে । যাবেন তাে ? হ্যাঁ ,যাব বলে পার্থ ঘর থেকে তার শােয়ার রুমে চলে গেল । ঘুমের সময় হয়েছে তবু ঘুম আসে না । তাহলে । পার্থ কি করবে । ভাবতে ভাবতে টেবিলের পাশে গিয়ে বসল । লেখার কিছু কিছু অভ্যাস পার্থর আগে থেকেই আছে । একটা কবিতা লেখার চেষ্টা করল । কাগজ কলম নিয়ে বসল । এবং লিখল
ভালবাসা বুঝি না তবে তােমাকে চাই,
তােমার আঁখিতে চোখ রাখতে চাই,
আমি যখনি তােমায় বলব ভাবি
মুখ শুকিয়ে যায় কি বলব ?
ভালবাসি ! ভয় হয় বুকে
যদি উত্তর না আসে ।তখন
পারব কি নিজেকে সামলাতে
তবুও ভালবাসতে চাই ।
বলতে চাই আমি তােমাকে ভালবাসি।
বলতে চাই তােমার সঙ্গ পেতে চাই,
তােমার চাহনি চাই , তােমার রূপের
বাহারিতে গর্ব করতে চাই,
তুমি আমার আমি তােমার
আমি শুধু তােমাকে চাই ।
কবিতাটা কাল অবশ্য অবন্তিকে দিব । ভাবল পার্থ । কিন্তু কখন দিবে । মনে মনে ঠিক করল কাল যখন তাকে নিয়ে বেড়াতে যাবে তখন রাস্তায় গাড়িতে দিবে । ভেবে ঠিক করল পার্থ পরে ঘুমিয়ে গেল ।
No comments