এক কাপ কফির মুল্যে খুঁজি সততা ❑ জাহাঙ্গীর বাবু
এক কাপ কফির মুল্যে খুঁজি সততা
জাহাঙ্গীর বাবু
❑
গত কয়েক মাস বেতন হচ্ছেনা ঠিক মতো। এই মাসেরটা ঐমাসে।গত দুই মাসে বেতনে ব এর দেখ নেই।বন্ধুদের কাছে এখন লজ্জার পাত্র।সিঙ্গাপুরের মতো ব্যয় বহুল এই দেশে কর্মজীবিদের মাস শেষে বেতন না হলে ঘর ভাড়া,খাবার,যাতায়াত,বাস ভাড়া,দেশে সংসার চালানো কত দুর্বিষহ যন্ত্রনা ভুক্ত ভোগী জানে।
এমনি টানা পোড়েনের এক সকালে এক প্রবাসী সকালের নাস্তা সারলো ডেস্কার রোডের ফখরুদ্দীন রেষ্টুরেন্ট থেকে দেড় ডলারের নরম খিচুড়ি দিয়ে।প্রতিদিনের অভ্যাস এক কাপ কফি।কর্মক্ষেত্রে ইন্সট্যান্ট প্যাকেটে সারলেও ছুটির দিনে মোস্তাফার কফি নেশার মতো।
বাড়িতে কল দিয়ে ম্যাসেঞ্জারে বউ বাচ্চাদের সাথে একটু সরাসরি কথা বলা রুটিন মাফিক চলে।
বাচ্চারা এখন গ্রাম ছেড়ে শহরের স্কুলে পড়ে।কর্মজীবি বউ বাসা নিয়েছে শহরে। একটা ফ্রিজ খুব দরকার।বউয়ের সাথে ফ্রিজের মুল্য বিদ্যুৎ বিল নিয়ে কথা চলছিল। নাহ, এ মাসে কোন মতেই সম্ভব নয়।এরই মধ্যে মোস্তফার কফি সপের লাইন একেবারে কাউন্টারে।
এককাপ কফির সাথে দোকানী মেয়েটা এক ডলার ফেরত দেয়।প্রবাসী বলে, আমি দশ ডলার দিলাম।দোকানী কনফিউজ।এখনতো সিসি টিভি ফুটেজ চেক করা সম্ভব নয়। এ দিকে কফি শপের লাইনে দাঁড়ানো লোকেরা বিরক্ত হচ্ছে। মেয়েটা নয় ডলার ফেরত দিয়ে দিলো।প্রবাসী বাড়ির সাথে কথা শেষ করে কফিতে চুমুক দেয়।
মুহহুর্তেই অপরাধ বোধ, অস্থিরতা বেড়ে যায়।জীবনের এত গুলো বছরে আজ অবধি এতটুকু মিথ্যা আর দুর্নীতির আশ্রয় নেয়নি সে। কঠিন সময়ে না খেয়ে দিন রাত পার করেছে বহুবার। এখন কি করবে বুঝতে পারছিলো না।গত কাল কর্মক্ষেত্রে এক সহকর্মীর কাছ থেকে পঞ্চাশ ডলার ধার নিয়েছিলো।দুপুরের খাবার,রাতের খাবারের পর যা থাকার কথা তার চেয়ে কম দেখা যাচ্ছে। মানি ব্যাগে কাগজের ভাঁজে এখন মাত্র তিনটি দশ ডলারের নোট। তার মানে চারটি নোট থেকে একটি দেয়া হয়েছে কফি শপে। না, আর ভালো লাগছেনা, কি করা যায়।
মানিব্যাগ চেককরা শুরু করে।মানি ব্যাগে তিন চারটে আইপি র কাগজ, কয়েকটা ভিজিটিং কার্ড, একটা ড্রয়িং স্কেচ, কয়েক মাসের দেশে পাঠানো টাকার ড্রাফটের কাগজ, পুরানো পারমিট,অন্তসারশুন্য ব্যাংক কার্ড,কয়েকটা স্কীল কোর্সের কার্ড, এর মাঝ থেকে বেরিয়ে এলো দুটি দুই ডলারের নোট।
সমস্যাটা আরো জটিল হলো।এই চার ডলার কি দশ ডলারের সাথের নাকি পুর্বের। অস্থিরতা আরো বাড়লো।চোখ বন্ধ করে ভাবতে লাগলো কালকের সারা দিনের খরচ।তাও মিলছেনা।এবার কফি শপের টেবিল থেকে কাউন্টারে।
সিস্টার তুমি এই নয় ডলার রেখে দাও। খুব আন ইজি ফিল করছি।
মেয়েটি বলল, আর ইউ কনফিডেন্ট টু রিটার্ণ দিস মানি।
ইয়েস, ইউ কিপ ইট। এট দা এন্ড অফ দা ডে ইফ ইট ইজ মাই মিস্টেক, ইউ হেভ টু পে ফ্রম ইউর সেল্ফ,দেন আই ইউল বি গুলটি,মাই কান্ট্রি, মাই হোম ল্যান্ড বাংলাদেশ উইল বি গিল্টি।তোমরা বলবে আমি, আমরা চোর।
লাইনে দাঁড়ানো লোকেরা চেয়ে রইলো প্রবাসীর দিকে।প্রবাসী আরো বলল, এভ্রি ইভিনিং আই কাম হেয়ার, হাউ আই কাম হেয়ার উইথ দিস নাইন ডলার ক্রাইম। ইফ মিস্টেক ফ্রম ইউ, আই নেভার মাইন্ড।টেল ইউর কলিগ টু রিটার্ণ মি।
প্রবাসী জানে, ওদের ভুল হলে এই নয় ডলার আর সে পাবেনা।তাও তার এখন ভালো লাগছে।প্রফুল্ল মনে বাসার কাছে আসতেই মনে পড়ে, আরে যদি দুই ডলার সে দিয়ে থাকে,তাহলে এক ডলার সে ফেরত পাবে।নাহ, আর যাবে না সে এক ডলারের জন্য। বিলিয়ন ডলারের প্রতিষ্ঠানে, এক আর নয় ডলারের মুল্য বালুচরের এক বিন্দু ধুলি কণা নয়।কিন্তু অপরাধবোধ নিয়ে বেঁচে থাকা অনেক যন্ত্রনার।
সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতেই মনে পড়ে গত সাপ্তায় তিন বন্ধু শাপলা থেকে খেয়ে কথা বলতে বলতে বেরিয়ে যায় বারো ডলার বিল দেয়া হয়নি। গত রাতে খাবারের বিল হয়েছিলো আট ডলার। আরেক বাংলাদেশী প্রবাসী দোকানে ক্যাশে থাকা বালককে বলে, গত সাপ্তাহর বারো আজকের আট,রেখে দিন বিশ ডলার। ক্যাশে থাকা মালিক পুত্র বললো, আংকেল ইউ আর লয়াল এন্ড টু গুড।উই ক্যান সে বাংলাদেশী আর লয়াল।উই কেন প্রাউড এজ বাংলাদেশী।
দুই, দশ,বিশ ডলার, বড় এমাউন্ট নয়। দেশে কোটি কোটি টাকা লোপাটের কাছে ধুলি কণা পরিমান অপরাধ নয়,বিষয়টা বিশ্বাসের,নীতির,সততার।ইচ্ছে করলেই ঠিক করা যায়,সমাজ,দেশ,পৃথিবী।
প্রতিনিয়ত এই প্রবাসে ভিসা নিয়ে ধোকা দিচ্ছে দেশীরা, দেশীভাইদের।লুটে নিচ্ছে লক্ষ লক্ষ টাকা,হুন্ডি, সোনা চোরাচালান করে ক্ষুন্ন করছে দেশের নাম,নিজেদের প্রমান করছে চোর,প্রতারক,দুর্নীতিবাজ হিসাবে।
আসলেই কি অর্থ উপার্জনের জন্য অবৈধ পন্থা জরুরী।ক' দিন বাঁচবে মানুষ, ক’দিনের এই দুনিয়াদারী।এক দিনতো মরতেই হবে।কি বলেন।
ভালো থেকো প্রবাসী, সৎ থেকো আমরণ।
No comments