নিস্তব্ধ নিশুতিনী ❑ সাবরিনা মোয়াজ্জেম ❑ পর্ব_১০ শেষ পর্ব
নিস্তব্ধ নিশুতিনী
সাবরিনা মোয়াজ্জেম
❑
পর্ব_১০
শেষ পর্ব
আমি জীবনের তরে সবাইকে ছেড়ে আজ
থেকে পয়ত্রিশ বছর আগে চলে এসেছি বলেই দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়লো পাভেল। বলি, আর কোনো
দিন খোঁজ নেননি? নাহ। কেনো? নিতে ইচ্ছে করেনি! আর কোনদিন যাবেননা সেখানে? নাহ।
সেদিনের মতো পাভেলের সাথে আমার কথা শেষ হলো। পাভেল ফজরের নামাজ পড়ে চলে গেলো
এয়াতিম খানায় শিশুদের পড়াতে।
আমার সাথে পাভেলের পরিচয় দীর্ঘ
বছরের। আমরা দুজন ই কাছাকাছি বয়সের। সেই যে দাঁড়ি গোঁফ রাখা নওজোয়ান পাভেলকে এই
এলাকায় নতুন আগুন্তকঃ হিসেবে সেই থেকেই আমার এক ধরনের কৌতুহল ছিলো। কিন্তু অজানা
কারণে তার সাথে সালাম বিনিময় ছাড়া কোনো কথা হতোনা কারণ পাভেল নিজেকে সব সময় গুটিয়ে
রাখতো। ছোট ছোট এতিম বাচ্চাদের পড়াতো। নৈঃশবিদ্যালয়ে রাতের বেলায় বড়দের পড়াতো
সেখান থেকে যা আসতো তা দিয়েই ছোট এক চালা টিনের ঘরে থাকতো রান্না করতো নিজ হাতেই।
বাকি সময় টুকু মসজিদে ই কাটিয়ে দিতো। তাই ইচ্ছে থাকা সত্তেও তার সাথে কথা বলার
সাহস পেতাম না। হাঁটা চলা করার সময় তসবিহ থাকতো সে তসবি গুনেই হেঁটে পুকুরে গোসল
করতে যেতো। তাছাড়া তেমন একটা মসজিদ থেকে বের হতোনা। সব সময় উদাসীন থাকতো। কোন
ধ্যানে মগ্ন থাকতো তা আল্লাহ ভালো জানতেন। এ নিয়ে পাড়ার কেউ কোনো দিন কথা তুলেনি
আজ এতো বছর পরেও কেউ কথা তোলেনা। পুকুর ঘাটে দেখা হওয়ার সুত্র আর নামাজের সময় দেখা
হওয়ার সুত্র ধরে দীর্ঘ দিনের পরিচয়। কিন্তু কোনো দিন সাহসে কুলায়নি তার গ্রামের
বাড়ি কোথায় জিজ্ঞেস করার। তখন আমিও জোয়ান মর্দ সরকারি চাকুরে, সংসার, বাচ্চা
কাচ্চা তাই সময় তেমন কুলোয়নি! দীর্ঘ পয়ত্রিশ বছর ধরে এই গোপন চাওয়াটা মনের মধ্যেই
ধরে ই রাখি। জীবনের প্রয়োজনে জীবন যেনো আমার তাড়াতাড়ি ই ফুরিয়ে যায়। কারণ ব্যস্ত
জীবন খুব তাড়াতাড়ি ই যেনো শেষ হয়ে যায়। ইদানিং বছর দুই ধরে বয়স হয়ে যাওয়ায় আমিও
মসজিদে আসা যাওয়া করি। আল্লাহর জিকির করি। সেই থেকে হালকা পাভেলের সাথে ভাব।
এই ভাব আমাদের আজ প্রায় দু বছর
গড়ালো। একদিন এমনি এক শ্রাবণে দেখি পাভেল সেজদায় ডুকরে কাঁদছে! আমি পাভেল পাভেল
করে ডাকছি কিন্তু আমার আওয়াজ পাভেলের কানে ডুকছেনা। তার অনেক্ক্ষণ পর পাভেল সেজদাহ
থেকে উঠলো। সেই থেকে তার প্রতি আমি আরও বেশি দুর্বল হয়ে পরি। একদিন বাড়ি থেকে কিছু
ভালো খাবার নিয়ে আসি। পাভেল বিনিয়ের সাথে তা ফিরিয়ে দেয়। কিন্তু আমি পাভেলের পিছু
ছাড়িনা। এতে আমার লাভ হয় আল্লাহর সাথে আরও সম্পর্ক তৈরি হওয়া আর মসজিদে আমার দীর্ঘ
সময় কাটিয়ে দেয়া। কোরান, কিতাব পড়ি, পাভেলের দীর্ঘদিনের পড়াশোনা আমাকে অনেক কিছু
নতুন করে শেখায়। আমিও মনোযোগ দিয়ে তার কথা শুনি। কারণ আমারও চাকরি শেষ। ছেলে মেয়ে
বিয়ে দিয়ে ঝাড়া হাত পা। আমার স্ত্রীও না ফেরার দেশে চলে গেছে বছর খানেক আগে। এখন
আমার একান্ত সময় কাটে পাভেলের সাথে মসজিদে। এছাড়া বাইরে কখনো আমাদের কথা হয়না।
পাভেলকে আমার ছোট বেলার নানা দুঃখ বলি, পাভেল শোনে। এক অদ্ভুত সখ্যতা গড়ে উঠে
আমাদের দুজনার মাঝে। আমি একটু দেরিতে এলে পাভেল আমার জন্যে অপেক্ষা করে। আমিও
পাভেলের জন্যে অপেক্ষা করি। এই করে দুজন ভালো বন্ধু হয়ে উঠি। আবার ফিরে এলো শ্রাবণ
মাস। সেদিন পাভেলের কান্নায় আমিও কাঁদি। সেদিন পাভেলেকে বিনয়ের সহিত জিজ্ঞেস করি
এমন কি হয়েছিলো আপনার জীবনে যা অন্তত আমার মতো বন্ধুকে বলতে পারেন না। অনেক
অনুনয়ের পরে কথার ঝাপি খুলে বসে পাভেল তখন রাত্রি নিশুতিনী, তাহাজ্জুদ পড়া হয়ে
গিয়েছিলো দুজনার ই। তখন শ্রাবণের কান্না আর পাভেলের কান্না একাকার হয়ে যায়। কান্না
ছোঁয়াছে কিনা জানিনা সাথে আমিও কাঁদি! আমাদের দুজনার কান্নায় শ্রাবণ ভিজিয়ে নিয়ে
যায় পাভেলের অতীতে কারণ এমনই এক শ্রাবণে রুবা ইহজগত থেকে বিদায় নিয়েছিলো।
সমাপ্ত........
No comments