Header Ads

বিট্টু _ তারেক আল মামুনের লেখা ছোট গল্প

বিট্টু

নামটা প্রথম শুনি ১৯৯০ সালের দিকে। আমি তখন বেশ ছোট। পাশের বাসার ওরা ভিসিপি ভাড়া করে এনেছে। ভারতীয় বাংলা ছবি “অঞ্জলি” চলছে। নায়কটা বেশ বোকাসোকা টাইপের। নায়ক বা নায়িকা কারোও নাম মনে নেই। মনে আছে শুধু সিনেমা আর বিট্টুর নাম। কী দারুণ অভিনয়! কী চমৎকার এ্যাকশন বিট্টুর! ভাবছি কিভাবে সম্ভব? আমি শুধু বিট্টুকে নিয়েই চিন্তা করছি। সিনেমা শেষে বাসায় আসলাম। মনে মনে ঠিক করলাম আমারও একটা বিট্টু দরকার। বিট্টু খোঁজা শুরু করলাম।
৩ বছর পার হয়ে গেল আমি ক্লাস সেভেনে উঠলাম। অবশেষে ডিগ্রী কলেজের কাছে এক বাড়ি থেকে নিয়ে আসলাম বিট্টুকে। আমার খেলার সাথী, হালকা লাল রংয়ের বেশ নাদুসনুদুস। সারাদিন চিন্তা বিট্টুকে নিয়ে। বিট্টু কী খাবে? কী করছে? বাবা একটু রাগ করলো আমার উপর। বললো “যেখান থেকে নিয়ে এসেছো সেখানেই রেখে এসো।“ যাই হোক আমি বুঝাতে সক্ষম হলাম সারাদিন একটু বিট্টুর সাথে খেলব, বাসায় থাকবো আর পড়বো। আমার সময় কাটতে শুরু করলো বিট্টুকে নিয়ে।
বিট্টু এখন বুঝতে পারে ওর নাম বিট্টু। ডাক দিলেই লেজ নাড়াতে নাড়াতে চলে আসে কাছে।
শুরু হলো ওর ট্রনিং এর পালা। বিট্টু দারুণ লাফাতে পারতো, একেবারে সেই অঞ্জলি সিনেমার বিট্টুর মতো। আমি টেনিস বল দূরে ছুঁড়ে দিতাম, বিট্টু মুখে করে নিয়ে আসতো। শূন্যে ছুড়ে দেওয়া খাবার লাফিয়ে লুফে নিতো। আমি সাইকেল চালাতাম বিট্টু আমার সাথে দৌড়াতো। আমি অবাক হয়ে দেখতাম। ধীরে ধীরে বিট্টু যেন আমার বন্ধু হয়ে উঠলো। আমি যেখানে যাই বিট্টুও সেখানে। ছায়ার মতো আমাকে অনুসরণ করে। বিট্টু যেন আমার এক শক্তি। ধীরে ধীরে আমরা দুজনেই বড় হতে লাগলাম।
১৯৯৭ সাল। আমি এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে রাজশাহী সিটি কলেজে ভর্তি হলাম। বিট্টুকে ছেড়ে আসতে হলো। এতোদিনে বুঝতে পারলাম একটা প্রাণী কিভাবে মানুষের হৃদয়ে স্থান করে নেয়। কিছু দিন পরে বাসায় আসলাম। বাবা-মা সাথে দেখা করেই জোরে ডেকে উঠলাম, বিট্টু...। আবার ডাকলাম, বিট্টু..............। কোথায় থেকে যেন দৌড়ে এলো লেজ নাড়াতে নাড়াতে৷ এসেই দুই পা উঁচু করে সালামের ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে পড়লো। আমি গায়ে হাত বুলিয়ে দিলাম। ওর জন্য বিস্কুট এনেছি। সেগুলো শূন্য ছুড়ে দিলাম। আগের মতোই লুফিয়ে নিলো। কয়েকদিন বন্ধু বান্ধব আর বিট্টুর সাথে দারুণ সময় পার করলাম।
ছুটিতে বাড়ি আসলেই জোরে ডেকে উঠি, বিট্টু.......। লেজ নাড়াতে নাড়াতে চলে আসে আমার প্রিয় পোষা বিট্টু।৷ ইতোমধ্যে বিট্টুর নাম এলাকার সবাই জেনে গেছে। সবাই বিট্টুকে চিনে।
সবাই বিট্টুকে আদর করে খাবার দেয়। বিনিময়ে আমার বিট্টু সারারাত পাহারা দেয় পুরো গ্রাম।
১৯৯৭ সালে কোরিয়ান হুন্দাই কোম্পানি আসে সারিয়াকান্দিতে যমুনা নদীতে গ্রোয়েন বাধ নির্মাণের জন্য। কোরিয়ানদের একটা বদ অভ্যাস ওরা নাকি কুকুর খায়! এলাকায় রাতারাতি কুকুর সাপ্লায়ার বেড়ে গেলো। আমি তাড়াতাড়ি বাড়িতে এসে বিট্টুর গলায় বেল্ট পড়িয়ে দিলাম, আর কপালে কালো কলপ দিলাম দিয়ে লম্বা একটা দাগ দিলাম যাতে সবাই চিনতে পারে।
এখন সারিয়াকান্দী প্রপারের প্রায় সবাই চিনে আমার বিট্টুকে। গলায় বেল্ট, কপালে সাদা রংয়ের মাঝে কালো কলপের দাগ। যেন ইউনিক এক বিট্টু।
১৯৯৯ সাল। আমার এইচএসসি পরীক্ষা। পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ততা বেড়ে যায়। দীর্ঘ তিনমাস পরে বাড়িতে আসি। এসেই বিট্টুকে ডাক দেই, বিট্টু.........। বিট্টু.........। বিট্টু.........।
বিট্টু দৌড়ে আসে। গালায় বেল্ট নেই, কপালের কালো রংটা মুছে গেছে। শরীরের পিছনের দিকে একটা কাটা চিহ্ন৷ মনে হচ্ছে ওর উপর দিয়ে প্রচন্ড ঝড় বয়ে গেছে। আমাকে দেখে ধীরে ধীরে লেজ নাড়াতে থাকলো। ওর কালো গভীর চোখ দুটো যেন পানিতে টলমল করছে। কিছু বলতে চাচ্ছে।
পরে লোকমুখে শুনলাম ওকে নাকি কুকুর সাপ্লায়াররা ধরেছিলো, কোরিয়ানদের কাছে বিক্রয় করার জন্য। কিন্তু পরিচিত একজনের জন্য বিক্রয় করতে পারেনি। ছেড়ে দিয়েছে।
আমি আবার গলায় বেল্ট লাগিয়ে দিলাম, কপালে কালো কলপ আর কাটা জায়গায় নেবানল পাউডার দিয়ে চিকিৎসা করালাম। ধীরে ধীরে বিট্টু আবার যেন স্বাভাবিক হয়ে উঠলো। ফিরে পেল তার প্রাণ চঞ্চলতা।
বিশ্ববিদ্যালয়ে এডমিশনের জন্য আবারও রাজশাহী চলে গেলাম৷ অনেকদিন বাড়ি আসা হয়নি। এডমিশন শেষে বাড়ি আসলাম। বিট্টু..........। বিট্টু........। করে ডাকতে থাকলাম৷ বিট্টু আসলো না। আশেপাশে খোঁজ করলাম৷ ভাবলাম দূরে কোথাও গেছে। রাতেও এলো না৷ পরদিন সকালে আবার ডাকলাম সারা পেলাম না৷ মনের মধ্যে অজানা একটা শঙ্কা তৈরি হলো। পরিচিত সবাইকে বললাম। কেউ খোঁজ দিতে পারলোনা। আমি প্রতিদিন আশা করতে থাকলাম হয়তো আজ রাতে আসবে আমার প্রিয় বিট্টু। তিনবেলা খাবারের সময় হলে বিট্টু বিট্টু করে ডাকতে থাকলাম অনেকদিন। লাল রংয়ের কোন কুকুর দেখলেই বিট্টু বলে ডাক দেই। কপালে কালো রং খোঁজার চেষ্টা করি।
অনেকদিন পেরিয়ে গেছে। এখনও লাল রংয়ের কুকুর দেখলেই অস্পষ্ট স্বরে বিট্টু বলে ডেকে উঠি। আমার বিশ্বাস একদিন ঠিকিই লেজ নাড়িয়ে সারা দিবে আমার আদরের প্রিয় বিট্টু।
তারেক আল মামুন

No comments

Powered by Blogger.