Header Ads

করোনা ভ্যাকসিন এবং আল্লাহর সৈনিক করোনা

 

করোনা ভ্যাকসিন এবং আল্লাহর সৈনিক করোনা
জিয়াউদ্দীন আহমেদ
করোনা ভাইরাস কিছু দিন যাবত ওয়াজের মুখ্য উপজীব্য হয়ে পড়েছিলো।প্রথম প্রথম প্রায় সকল ওয়াজে বলা হলো, করোনা ভাইরাস বিধর্মীদের ওপর একটা গজব, তাদের শায়েস্তা করতেই আল্লাহ এই ভাইরাস পাঠিয়েছেন।ইতালি প্রবাসী একজনের সাথে করোনার কয়েক ঘন্টার সাক্ষাৎকার শুনে মুফতি কাজী ইব্রাহিম নিশ্চিত হয়েছিলেন যে, করোনা বাংলাদেশে আক্রমন করবে না।কারণ বাংলাদেশে যত ওয়াজ- মাহফিল হয় তা আর কোন দেশে লক্ষ্য করা যায় না।হ্যান্ডশেক বন্ধ হওয়ার ব্যাখ্যায় তিনি উল্লেখ করেন যে, পুরুষ ও মহিলাদের হাতের তালুতে অসংখ্য বিপরীতধর্মী সেক্সস্যুয়াল কোষ থাকায় হ্যান্ডশেক করলেই উভয়ের শরীরে যৌবনের আগুন জ্বলে উঠে এবং এই আগুনময় যৌন উত্তেজনাকে ঠেকাতে করোনা ভাইরাস হাতের তালুতে আক্রমন করছে।স্বাস্থবিধির বিরুদ্ধে ক্ষেপে এক হুজুর বললেন, ‘আমরা এতদিন বলে এসেছি, কাঁধের সাথে কাঁধ লাগিয়ে কাতার সোজা করে না দাঁড়ালে সহি নামাজ হবে না, এখন আমাদের দিয়ে বলানো হচ্ছে তিন ফুট দূরে দূরে দাঁড়তে’।মুফতি আমির হামজা জনসমাবেশে প্রকাশ্যে ঘোষণাই করলেন, কোন মুসলমানের করোনা হলে কোরান মিথ্যা হয়ে যাবে।একজন মুফতি তো বলেই দিলেন যে, মে মাসের ১২ তারিখের পর করোনা পৃথিবীতে আর থাকবে না, কারণ ঐ দিন সুরাইয়া তারা আকাশে উঠবে। হুজুরদের বয়ানে সাধারণ মুসলমানদের মনে বিশ্বাস জন্মেছিলো যে, রমজানের রহমতের উছিলায় করোনা রমজান মাসে উবে যাবে।মাওলানা মুফতি গিয়াস উদ্দিন আত তাহেরি বলেছেন, চীনে ওহানে যখন করোনার প্রথম প্রাদুর্ভাব হয় তখন খোলা মাঠে সকল ইহুদি মুসলমানদের সাথে নামাজে দাঁড়িয়ে গেলেও মুসলিম দেশগুলো মসজিদে নামাজ আদায় বন্ধ করে দিয়েছে।অন্য হুজুর বলেছেন, সুরা নাস পড়ে হাতে ফু দিয়ে মুখে ঘষে দিলে মাস্ক পরার প্রয়োজন নেই।যারা ওয়াজ করেন তাদের অধিকাংশই মুফতি; একজন মুফতি ইসলামি আইনশাস্ত্রের ব্যাখ্যা ও ফতোয়া প্রদান করার ব্যাপারে স্বীকৃত আলেম।
প্রকৃতির তান্ডবে মানুষের অসহায়ত্ব বেড়ে গেলে সহজাত প্রবৃত্তি থেকে মানুষ ধর্মকর্মে মনোযোগী হয় বেশী।ধর্মপ্রাণ লোকদের আবেগ অনুভূতির পুরোটাই দখল করে রেখেছে ধর্ম।এমন অনুভূতিকে কাজে লাগিয়ে কিছু আলেম ধর্মের বিধিবিধান উপেক্ষা করে যাচ্ছেতাই বয়ান দিতে থাকেন।এদের এমন বয়ানে যখন মানুষ পরবর্তীতে সত্যতা খুঁজে পায় না তখন ধর্মের ব্যাপারে হতাশার সৃষ্টি হয়।ওয়াজ হচ্ছে উপদেশ, এই ওয়াজ শোনার জন্য আমরা শীতকালে মাঠে খড়ের মধ্যে বসে সারারাত কাটিয়ে দিয়েছি, ওয়াজ শোনার জন্য আমরা দূর দূরান্তেও ছুটে গিয়েছি।ওয়াজ শুনে বাল্যকালে আমরা প্রশ্নাতীতভাবে দোজখের আগুন থেকে রহম পাওয়ার প্রত্যাশায় হুজুরের সাথে কেঁদেছি।এখনকার মতো তখন সাম্প্রদায়িক, উস্কানিমূলক ও বিদ্বেষ ছড়ানোর বক্তব্য দেয়া হতো বলে মনে পড়ে না।করোনাকে নিয়ে ইহুদি, খ্রিস্টান, হিন্দুদের মধ্যেও ধর্মীয় বানী প্রচার করতে দেখা গেছে।বিজেপি’র তত্ত্বাবধানে পশ্চিমবঙ্গের রাস্তায় শিক্ষিত-অশিক্ষিত নির্বিশেষে সকল পথচারীকে স্বেচ্ছায় গোমূত্র পান করে করোনা থেকে মুক্তির জয়গান গাইতে দেখা গেছে।
স্কুল জীবন পার হওয়ার পর ধর্মের মাহাত্ম গেয়ে ধর্মকে বড় করার মিথ্যা অপচেষ্টা দেখেছি।১৯৬৯ সনে চাঁদে মানুষের পদার্পনের পর বলা শুরু হলো, যারা চাঁদে গিয়েছেন তারা চাঁদে আজানের আওয়াজ শুনতে পেয়েছেন, চাঁদ দুই ভাগ হওয়ার চিহ্নও তারা দেখে এসেছেন, পৃথিবীতে ফেরত এসে নীল আর্মস্ট্রং ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছেন ইত্যাদি ইত্যাদি।ভুল ও মিথ্যে তথ্য দিয়ে ধর্মকে গৌরবান্বিত করার এই অপচেষ্টা আর থামেনি।কোন আলেম বা ধর্মপ্রাণ ব্যক্তিকে এই সকল মিথ্যা প্রচারের বিরুদ্ধে বলতেও শুনিনি।শুধু হুজুরদের বলি কেন, শিক্ষিত লোকেরাও অলৌকিক কুদরতিতে বিশ্বাস করেন।হুজুরদের মতো এক চিকিৎসক মিডিয়ায় এসে জোর গলায় বললেন, এপ্রিলের ১৫ তারিখের পর গরম আবহাওয়ায় করোনা উধাও হয়ে যাবে।১৯৩৪ সনের ১৫ জানুয়ারিতে ভারতবর্ষের বিহার ও অপরাপর কয়েকটি এলাকায় ভূমিকম্পে যানমালের প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়; মহাত্মা গান্ধী এই ভূমিকম্পকে হিন্দুদের মধ্যে বিরাজমান ‘অস্পৃশ্যতার’ শাস্তি বলে উল্লেখ করেছিলেন।
নানা বিপর্যয়কর ঘটনার মধ্যে পড়ে অসহায় মানুষগুলোর মধ্যে পরকালের ভাবনার তীব্র উদ্গ্রেক করে বলেই এমনতর আজগুবি কাহিনীর অবতারনা হয়।মানুষের আচার-ব্যবহার, দোষ-ত্রুটির কারণেই রোগ-ব্যাধি, ভূমিকম্প, ঝড়, বৃষ্টি ইত্যাদির উদ্ভব হয় এমন কথা বিজ্ঞানে বিশ্বাসী মানুষকে বিমূঢ় করলেও অগণিত লোক সহি বলেই মনে করে।আগের দিনে কাউকে শাস্তি দেয়ার আগে তাকে পাপী হিসেবে অপরাধী করা হতো; পাপের কারণে ঐশ্বরিক ক্রোধের কথা বলে প্রাচীনকালে যুক্তিবাদীদের মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত করার সহজ পথ যাজকেরা অনুসরণ করেছে।ইউরোপে ধর্মমতের বিরুদ্ধবাদীদের বিচার করার জন্য খ্রিস্টান যাজকদের ক্ষমতা ছিলো অপ্রতিরোধ্য।ধর্মের সাথে সাংঘর্ষিক বিজ্ঞানের কথা বলার জন্য জিওরদানো ব্রুনোকে পুড়িয়ে মারা হয়েছিলো, যুক্তির কথা উচ্চারণের জন্য সক্রেটিসকে বিষ খাইয়ে মারা হয়েছিলো, অনেককে ডাইনি আখ্যা দিয়ে পুড়িয়ে মারা হয়েছে।ভারতে এখনো বিভিন্ন বালামুছিবত থেকে বাঁচার লক্ষ্যে মাঝে মাঝে প্রবীণ নারীদের ডাইনি আখ্যায়িত করে পুড়িয়ে মারা হয়।খালেদা জিয়া ক্ষমতায় আসার পর একবার প্রচুর ঝড়-বৃষ্টি হচ্ছিলো- বিরোধী দলের লোকজন বলতে শুরু করলো যে, ‘খালেদা জিয়া অপয়া’; মাহমুদুর রহমান মান্না তখন এমন মন মানসিকতার বিরোধিতা করে কলম ধরেছিলেন।অস্টাদশ শতাব্দিতেও আমেরিকান বোস্টনের প্রধান ধর্ম যাজকগণ বলেছিলেন যে, গৃহের উপর বজ্রপাত-নিবারক লৌহদন্ড স্থাপনের জন্যই ম্যাসাচুসেটস-এ ভূমিকম্প হয়েছে।অপরাধের শাস্তি যদি করোনার প্রাদুর্ভাব হয় তাহলে কার অপরাধে কে শাস্তি পেল? সারা পৃথিবীর সব লোকই কি একযোগে অপরাধ করেছে? ধর্মে সত্যের উপর প্রশ্নাতীত বিশ্বাস থাকায় আমরা আর কোন সত্য জানার তাগাদা বোধ করি না।ধর্মের সাথে না মিললে বিজ্ঞানকে দ্বিধাহীন চিত্তে অস্বীকার করার জন্য আমরা সদা প্রস্তুত।কিন্তু বিশ্বাস করার প্রবৃত্তি আর সত্যানুসন্ধানের আগ্রহ এক বস্তু নয়।
আমরা ধর্ম পালন করব, ধর্ম মানবো, কিন্তু অন্ধভাবে নয়।যারা ওয়াজ করেন তাদের একটি সন্মোহনী শক্তি রয়েছে।এরা যেভাবে পরকালের ভয় ও অনাবিল সুখের লোভ দেখান তাতে সবাই মৃত্যু পরবর্তী জীবনের জন্য আতঙ্কিত ও উল্লাসিত হয়ে হুজুরের সব কথায় ‘মারহাবা মারহাবা’ বলে মাঝে মাঝে চেচিয়ে উঠেন।ভয়ে বিহ্বল লোকগুলোর উপর এদের বলার প্রভাব অনেক শক্তিশালী।এই নশ্বর পৃথিবীতে যারা প্রচুর পেয়েছে আর যারা কিছুই পায়নি উভয় গ্রুপই সমানভাবে পরকালে পাওয়ার আশায় ভুল-ভ্রান্তি সব বিনা বাক্যে মেনে নেন।কিন্তু ধর্মযুদ্ধ শুধু বাইরে জেতার নয়, হেরে গিয়েও জয় করেছেন এদেশের সূফি সম্প্রদায়।শুধু তলোয়ারের ভয় নয়, ইসলামের সাম্যবোধও ইসলাম ধর্ম গ্রহণে অনেককে অনুপ্রাণিত করেছে।
করোনা থেকে মুক্তি পাওয়ার প্রবল আগ্রহ ও বিশ্বাসে প্রথমদিকে জনগণ ধর্মে আশ্রয় খুঁজেছে, কিন্তু দীর্ঘদিনেও তার কোন অবসান না হওয়ায় ধর্মের আশ্রয়ে মুক্তি পাওয়ার প্রত্যাশা কমেছে।ইত্যবসরে করোনার আবিস্কৃত প্রতিষেধক ভ্যাকসিন ফলপ্রসূ প্রমাণিত হয়েছ; কিন্তু প্রতিষেধক গ্রহণের পূর্ব পর্যন্ত আরও কিছু লোকের মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী।ওয়াজ শুনলে এখন আর ঈমান, বিশ্বাস ও আখেরাতের কথা মনে পড়ে না, মনে গেঁথে যায় অন্যকে নিয়ে হুজুরের বিনোদন করার অঙ্গভঙ্গি, কুৎসা রটনায় ব্যবহৃত বাচনভঙ্গি, গালাগালির কুৎসিত ভাষা।ধর্মীয় বক্তা হিসেবে মিজানুর রহমান আজহারী এখন বেশ জনপ্রিয়।তিনি যখন বলেন করোনা আল্লাহর সৈনিক তখন আমাদের মধ্যে করোনার চিকিৎসায় ভ্যাকসিন গ্রহণ নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়; কারণ ভ্যাকসিন নিলে তো আল্লাহর সৈনিকের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লড়তে হয়।সৃষ্টিকর্তার এই সৈনিককে প্রতিহত করতে গিয়ে ভ্যাকসিনের ব্যবহার ধর্ম বিরোধী হিসেবে বিবেচিত হবে না তো? করোনা হুজুরের বয়ান আর গোমূত্র যখন করোনা মুক্তির প্রধান প্রতিকার ও প্রতিষেধক হয় তখন গবেষণায় নির্ণিত স্বাস্থবিধি ও ভ্যাকসিনের প্রতি ধর্মপ্রাণ সাধারণ মানুষের কোন আগ্রহ থাকার কথা নয়।

লেখক বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী
পরিচালক ও সিকিউরিটি প্রিন্টিং কর্পোরেশনের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক
ahmedzeauddin0@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.