কোরবানি, পশু প্রেম এবং মানবিকতা
কোরবানি, পশু প্রেম এবং মানবিকতা
জিয়াউদ্দীন আহমেদ
বাংলাদেশে পশুদের ভোট না থাকায় তাদের কোন অধিকারও নেই।তাদের উপর অত্যাচার, নির্যাতনের মাত্রা আদালতে গিয়ে নালিশ করার বাকশক্তি না থাকায় কিছু হৃদয়বান মানুষের অনুকম্পার উপর তাদের বাঁচা-মরা নির্ভর করে।বন্যার পানিতে অধিকাংশ স্থলভূমি ডুবে যাওয়ায় গর্তে বাস করা ইঁদুর, শিয়াল ইত্যাদি প্রাণীগুলো বেরিয়ে আসার সাথে সাথে লাঠি হাতে শিশু, কিশোরেরা তাদের পিটিয়ে মেরে ফেলছে।ফসল খাওয়ার অভিযোগে মাও সে তুং ক্ষমতায় এসেই চড়ুই পাখি মারার নির্দেশ দিলে একদিনেই ৬৬ কোটি পাখি মেরে ফেলা হয়।কিন্তু প্রকৃতির শৃঙ্খলিত উপাদানগুলোর কোনো একটি ক্ষতিগ্রস্ত হলে স্বয়ংক্রিয়ভাবেই পরিবেশগত ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যায়।কারণ শস্য দানার পাশাপাশি চড়ুই পাখি নানা ধরনের পোকামাকড়ও খায়।চড়ুই পাখি বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ায় জ্যামিতিক হারে বেড়ে গেল সেইসব পোকামাকড়ের সংখ্যা।পোকামাকড়ের আক্রমনে ফসল নষ্ট হলে চীনে যে দুর্ভিক্ষ হয়েছিলো তাতে দেড় কোটি লোক না খেয়ে মরেছিলো।প্রকৃতপক্ষে পশু, পাখিদের পক্ষ নিয়ে কোন মিছিল মিটিং হয় না, বক্তৃতার জন্য মঞ্চ তৈরি হয় না।কিছু কিছু সংগঠন বাংলাদেশে প্রাণীদের নিয়ে কাজ করে; এমন নির্মম হত্যার বিরুদ্ধে তাদের আরও বেশী সোচ্চার হওয়া প্রয়োজন।আবার কোন কোন ব্যক্তি বা সংগঠন পশু প্রেমিক সেজে ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধির কর্মকান্ডে জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে।পথের কুকুর-বিড়াল উদ্ধার করে তাদের জন্য সেবাশ্রম গড়ে তুলেছেন 'আদি গুরু' নামে পরিচিত নাঈম ইবনে ইসলাম। প্রাণীদের নিয়ে কাজ করা অপর সংগঠন ‘পিপল ফর এনিমেল ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশন’ ও ‘কেয়ার ফর পজ’ নাইম ইবনে ইসলামের বিরুদ্ধে পশু নির্যাতনের অভিযোগ উত্থাপন করেছে।তাদের অভিযোগ হচ্ছে, আদি গুরু পথপ্রাণির সেবার নামে দেশ-বিদেশের পশুপ্রেমি সংগঠন ও মানুষের কাছ থেকে অনুদান নিয়ে তা আত্মসাৎ করে গড়ে তুলেছেন বিত্ত-বৈভব।এই আদি গুরুর বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগের ভিত্তিতে বিভিন্ন পত্রিকায় যে প্রতিবেদন হয়েছে তাতে অযত্ন, অবহেলায় তার আশ্রমের কিছু কঙ্কালসার কুকুর বিড়ালের ছবিও ছাপা হয়েছে।
গরুর রচনা না লিখে পড়ালিখা শেষ করেছেন এমন ব্যক্তি বিরল, রচনার পুরোটাই গরুর উপকারিতা নিয়ে ভরা থাকতো।সেই গরুকে যখন অযত্ন, অবহেলা আর যন্ত্রণা দিয়ে কোরবানী দিই তখন রচনার উপকারিতার কথা মনে থাকে না।সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে কোরবানীর পশুর হাট বসানোর হাস্যকর ঘোষণাও কিছুটা সচেতনতা সৃষ্টি করতে পেরেছিলো বলে মনে হয়।এমন ঘোষণায় বসা কোরবানীর একটি পশুর হাটে পশু প্রেমের একটি কাহিনী পড়ে এই কলামটি লিখতে উদ্বুদ্ধ হয়েছি।মধ্য বয়সের কাঙ্কালসার দেহ নিয়ে মোটা-তাজা গরুটি বিক্রি করতে আসা কৃষকের পাশে বারো-তেরো বছরের একটি ছেলে মুখ বেজার করে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে।ছেলেটির কোনো কারণে মন খারাপ।গরু বিক্রি করে কৃষক টাকার বান্ডিল নিয়ে গরুর গলায় বাঁধা দড়ি ক্রেতার হাতে তুলে দিলেন।দড়ি ক্রেতার হাতে তুলে দেয়ার সাথে সাথে পাশে দাঁড়ানো ছেলেটির চোখ দিয়ে পানি পড়তে লাগলো।বাবা ছেলেটিকে বলছে, 'কান্দিসনা বাপধন, আমরা আরেকটা গরু পালব’।পরের দৃশ্যটি ছিল আরও করুণ।কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই ছেলেটি পাগলের মতো ছুটে এসে গরুটাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল।পশুর প্রতি মানুষের অকৃত্রিম ভালোবাসার প্রকাশ ঘটে তখন যখন একজন কিশোর বন্যার পানি থেকে রক্ষা করার জন্য তার নিজের প্রিয় গরুর বাছুরটিকে কাঁধে তুলে নেয়।আমরা কুকুরের প্রভুভক্তি দেখেছি, কিন্তু নিরীহ বোবা গরুও যে তার প্রভুকে ভালোবাসে তার নজিরও ভুরিভুরি।আমার বউয়ের শেয়ার করা একটা ভিডিওতে দেখলাম, একটি যুবকটিকে যতবার তার বন্ধু মারার ভান করেছে তত বার একটি গরু ঘাস খাওয়া বাদ দিয়ে তারে রক্ষা করতে ছুটে এসেছে।আদর যত্ন পেলে, ভালোবাসা পেলে গরুও ভালোবাসা ফিরিয়ে দেয়।কোরবানীর জন্য ক্রীত গরুর চোখে পানি আমরা অনেকে দেখেছি।এর দুটো কারণ থাকতে পারে; এক- তার পুরানো মনিবদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া, দুই- তার মৃত্যু সম্পর্কে বুঝতে পারা।এই আতঙ্কিত গরু যখন পা বাঁধা অবস্থায় জবাইয়ের পূর্ব মূহুর্তে বাঁচার শেষ চেষ্টায় আর্তচিৎকার করে তখনও গায়ের উপর চেপে বসা লোকগুলো হাসে, কারণ আগের দিন কিনে আনা গরু তাদের কোনভাবেই ধর্মে নির্দেশিত ‘প্রিয়জন’ নয়।
হযরত ইব্রাহিম (আঃ)-এর পুত্রের পরিবর্তে দুম্বার জবাই হয়ে যাওয়াকে আল্লাহ্র প্রতি তাঁর আনুগত্যের নিদর্শন স্বরূপ আমরা ঈদ-উল-আযহায় পশু কোরবানী দিয়ে থাকি।ইব্রাহিম (আঃ) স্বপ্নে নির্দেশিত হয়ে তাঁর সবচেয়ে প্রিয় বস্তু হিসেবে প্রথম ও দ্বিতীয়বার উট বেছে নিলেও তৃতীয়বারে বেছে নিয়েছিলেন পুত্র ইসমাইল (আঃ)-কে।নিজের প্রাণের চেয়ে পুত্রের প্রাণ বেশী প্রিয় কী না সেই বিতর্কের অবকাশ এখানে নেই।কয়েক বছর পূর্বে বাংলাদেশে এক ব্যক্তি হযরত ইব্রাহিম (আঃ)-এর অনুসরণে তার প্রাণপ্রিয় সন্তানকে কোরবানী দিয়ে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের কাছে উন্মাদ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছিলেন, এখনো বোধ হয় কারাগারে আছেন।আমার মনে হয় না তিনি উন্মাদ।পবিত্র কোরআনে কোরবানী দেয়ার নির্দেশনা রয়েছে।হযরত ইব্রাহিম (আঃ)-এর পরবর্তী কালে আসা হযরত মুসা (আঃ) বা হযরত ঈসা (আঃ)-এর জীবনকালে বা পরবর্তী সময়ে তাঁদের উম্মতদের মধ্যে এই কোরবানীর কোন নজির পরিলক্ষিত হয় না।এই দুই নবীর আমলে এর প্রচলন কেন হলো না তার কোন ব্যাখ্যা আমার জানা নেই।আমাদের নবী করিম ( স:)-এর নবুয়ত লাভের দশ বছরের মধ্যেও মক্কায় কোরবানীর প্রবর্তন হয়নি; এই কোরবানীর শুরু হয় নবী (স:)-এর মদিনায় যাওয়ার পর।
হযরত আদম (আঃ)-এর আমলেও আল্লাহর উদ্দেশ্যে উৎসর্গ প্রথা দেখা যায়।সুন্দরী বোনকে স্ত্রী হিসেবে পাওয়ার দুই ভাইয়ের দ্বন্দ্ব মিটাতে না পেরে আদম (আঃ) তাঁর দুই সন্তান হাবিল ও কাবিলকে স্রষ্টার উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করতে বলেন এবং তদনুসারে হাবিল একটি ভেড়া এবং কাবিল তার ফসলের একটি অংশ উৎসর্গ করেন; একজনের উৎসর্গ কবুল হয়, আরেকজনের হয় না।চার হাজার বছর পূর্বের ‘ইলিয়াড’ ও ‘ওডিসি’ মহাকাব্যেও দেবতার উদ্দেশ্যে পশুবলী দেখা যায়।ইলিয়াড আর ওডিসি’র সমসাময়িক কালে প্রবর্তিত হিন্দু ধর্মেও দেবতা বা দেবীর নামে পাঠা বলি দেয়ার রীতি রয়েছে।রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই পশুবলীর বিরুদ্ধে কলম ধরেছিলেন তাঁর ‘বিসর্জন’ কাব্যনাট্যে।বনী ইসরাইল জাতি গরু পূজা করত।প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতায়ও নরবলির প্রথা প্রচলিত ছিলো।নিরীহ পশু বলি দিয়ে দেবতাকে সন্তুষ্ট করে শক্তিশালী মানুষগুলো আরও নির্মম ও নিষ্ঠুর হয়ে উঠতো।নির্বাক পশুগুলোর এমন উৎসর্গে অত্যাচারি মানুষেরা ত্যাগের অহঙ্কারে গর্ব বোধ করতো, ত্যাগটা যদি পশুর না হয়ে অত্যাচারি শাসকদের হত্যার মধ্য দিয়ে ঘটতো তাহলে চেঙ্গিস খান, হালাকু খান, আলেকজান্ডারের হাতে লক্ষ লক্ষ নিরীহ মানুষের মৃত্যু হতো না।কোরবানীতেও মানুষ কোন কিছু ত্যাগ করে না, এমন কি মনের কালিমা দূর করার চেষ্টাও করে না।মানুষ কোরবানীতে কিছু ত্যাগ করে না বলেই দেশে অপরাধ, ঘুষ, দুর্নীতি কমছে না।অধিকাংশ ক্ষেত্রে ঘুষের টাকায় সবচেয়ে বড় গরুটি কিনে এনে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছবি দিয়ে সামাজিক মর্যাদা বাড়ানোর অপচেষ্টা করে থাকে।অবশ্য ধর্মে গরুর প্রতিটি লোমের জন্য আলাদা আলাদা পুরস্কার বা নেকির আশ্বাস থাকায় বড় গরু কিনলে বেশী পুরস্কার পাওয়ার নিশ্চয়তা রয়েছে।এছাড়াও গরুটি কেনার জন্য যে টুকু অর্থ ত্যাগ করতে হয় তা উসুল করার জন্য নতুন নতুন ফ্রিজও কেনা হয় যাতে দীর্ঘদিন মাংস জমা রেখে খাওয়া যায়।অবৈধ টাকায় কেনা গরু কোরবানী দিয়েও ছওয়াব পাওয়ার প্রত্যাশা করে মানুষ নামের অমানুষগুলো, কিন্তু যে গরুটি নিজের জীবন উৎসর্গ করলো সে কতটুকু ছওয়াব পাবে তা আমার জানা নেই; বরং পরকালেও এই কোরবানির জন্তু মানুষের পুলসিরাতের বাহন হবে।
কোরবানীর ঈদে উৎসর্গ করার জন্য যে সকল উট, ভেড়া, ছাগল ও গরু সীমান্তের ওপার এবং দেশের প্রত্যন্ত এলাকা থেকে আনা হয় তাদের অসহায়ত্ব সবাইকে ব্যথিত করে।সীমান্তের ওপার থেকে পাহাড় গড়িয়ে সীমান্তের এপারে গরু ফেলে দেয়ার দৃশ্য সহ্য করা যায় না।এবার নতুন কৌশলে বস্তায় ভরে বাঁশের কপিকল বানিয়ে গরুগুলোকে তারের বেড়া পার করাতে দেখা গেল।প্রতিটি জীবন্ত প্রাণির প্রতি দয়া প্রদর্শনের জন্য প্রশংসিত পুরস্কারের কথা উল্লেখ রয়েছে হাদিসে।অথচ খাদ্য, পানি ছাড়াই অপর্যাপ্ত স্থানে ট্রাকে গাদাগাদি করে যেভাবে তাদের দীর্ঘপথ অতিক্রম করতে হয় তা শুধু অমানবিক নয়, অধর্মও।বিশ থেকে বাইশ ঘন্টা পর্যন্ত একনাগাড়ে পশুগুলো দাঁড়িয়ে থাকে।অমসৃণ রাস্তায়, গতি প্রতিরোধকে ধাক্কা খেয়ে পশুগুলোর কষ্টের সীমা থাকে না, চোখ বেয়ে অশ্রু ঝরতে থাকে।
কোরবানী ছাড়াও প্রতিদিন কোটি কোটি পশু জবাই হচ্ছে।তবে প্রতিদিন যে পশু জবাই হয় তা সাধারণত জনসম্মুখে হয় না।প্রচন্ড যন্ত্রনাদায়ক জবাইয়ের দৃশ্য দেখে শুধু বয়ষ্করা নয়, শিশুরাও নির্মম নিষ্ঠূর হওয়ার শিক্ষা লাভ করে।বর্তমানে জবাই করা গরু, ছাগলের ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরুনোর দৃশ্য শিশুরা উপভোগ করে।কারণ বড়দের কাছে শুনে শুনে এমন জবাইকে স্বাভাবিক ঘটনা হিসেবে তারা গ্রহণ করে।গুলশান হোলি আর্টিজানে যেভাবে ধর্মের উগ্রতায় বিশ্বাসী কিশোরেরা সেখানে খেতে যাওয়া মানুষগুলোকে হত্যা করার পর টুকরো টুকরো করেছে তা বিকৃত মানসিকতার পরিচায়ক।তবে রাস্তা-ঘাটে কিশোর মাস্তানের হানাহানির পেছনে আমাদের সিনেমায় কথায় কথায় হত্যা আর খুনাখুনির অবাস্তব দৃশ্যগুলোও দায়ী।আমাদের শিশুদের জবাইয়ের বীভৎস দৃশ্যগুলো থেকে দূরে রাখা উচিত।তাছাড়া সব কাজ সবাই পারে না, পারলেও সবার করা বান্ছনীয় নয়।লাশকাটা ঘরে মৃত মানুষের পোস্ট-মোর্টেম করার জন্য নির্ধারিত লোক রয়েছে; সবাই পোস্ট মোর্টেম করার ব্যাপারে সাহসী হয়ে উঠলে পৃথিবীটি অসুস্থ মানুষের কসাইখানা হয়ে যাবে।কসাইয়ের পেশা হচ্ছে পশু জবাই করা, কিন্তু কোরবানীর পশু তাদের দিয়ে জবাই করা হয় না; কোরবানীর পশু জবাই করে পশুর ক্রেতা বা মাদ্রাসা, মক্তবের অদক্ষ লোকজন।এর ফলে অনেক ক্ষেত্রে অদক্ষ হাতে নির্মমভাবে পশু কোরবানী হয়ে থাকে।পশু কোরবানী মানবিক উপায়েও করা যায়।আমাদের ইসলাম ধর্মেও এর সমর্থন রয়েছে।ইসলাম ধর্মে জবাই করার পূর্বে ছুরিতে ধার দিয়ে নেয়ার নির্দেশনা রয়েছে যাতে তিন পোচে জবাই সম্পন্ন হয় এবং পশুর কষ্ট কম হয়।এছাড়াও জবাই করার জন্য টেনে-হেঁচড়ে শারীরিক কষ্ট দেয়া যাবে না, একটি পশুর সম্মুখে আরেকটি পশুকে জবাই করতেও ধর্মে নিষেধ করা হয়েছে।তাই ধর্মের নির্দেশনা পরিপালন করেই আমরা কোরবানী দিয়ে গরু, ছাগলের প্রতি অধিকতর মানবিক হতে পারি।
লেখক বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক
ও সিকিউরিটি প্রিন্টিং কর্পোরেশনের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক
ahmedzeauddin0@gmail.com
No comments