Header Ads

আমলাতান্ত্রিক জটিলতা এবং খাল ও জলাবদ্ধতার রাজনীতি



আমলাতান্ত্রিক জটিলতা এবং খাল ও জলাবদ্ধতার রাজনীতি
জিয়াউদ্দীন আহমেদ
জলাবদ্ধতা নিরসনে অতি সম্প্রতি অনুষ্ঠিত টেকনিক্যাল কমিটির এক সভায় খাল পরিস্কারে ওয়াসার নির্লিপ্ততা নিয়ে প্রশ্ন উঠলে ওয়াসা উত্থাপিত অভিযোগ অস্বীকার করে; তখন দক্ষিণের মেয়র ব্যারিস্টার ফজলে নুর তাপস সভা থেকেই স্থানীয় সরকার মন্ত্রীকে রামচন্দ্রপুর, বসিলা ও হাজারিবাগ খালের বর্তমান অবস্থা দেখাতে নিয়ে যান।এই তিনটি স্থানে খালের অবস্থা দেখে মন্ত্রী বলতে থাকেন, এর জন্য ওয়াসাকে শাস্তি পেতে হবে।ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় মেয়র ও মন্ত্রী মহোদয়ের সাথে খালের অবস্থা আমাদেরও দেখার সুযোগ হয়েছে।প্রথম দর্শনে ওখানে কোন খাল দেখতে পাইনি; কারণ একদিকে বিভিন্ন পয়েন্টে খালের কোন অস্তিত্ব নেই, ভরাট হয়ে গেছে, অন্যদিকে পচা-গলা আবর্জনার স্তর এত গাঢ় ছিলো যে পানি দেখা যাচ্ছিলো না।খালে পানিপ্রবাহ না থাকলে ময়লা-আবর্জনা যেখানে ফেলা হয় সেখানেই স্তুপাকারে জমে থাকে, ময়লা-আবর্জনা দীর্ঘদিন সরানো না হলে বদ্ধ পানিতে পচা-গলার দুর্গন্ধ আর মশার বংশবৃদ্ধি পরিবেশকে দু:সহ করে তোলে।অনেকগুলো খাল ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে।এমন অবস্থায় দুই সিটি কর্পোরেশনকে খাল রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব দেয়া হবে বলে মন্ত্রী ঘোষণা দিয়েছেন।
কোন এক সময় নাকি ঢাকা শহরে শতাধিক খাল ছিলো এবং খালগুলো নগরীর চারপাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষা, তুরাগ ও বালু নদীর সঙ্গে সংযোগ ছিল।শুনতে আজগুবি মনে হলেও ঐ সকল খাল দিয়ে নাকি এক সময় লঞ্চ চলতো।তবে খালের হিসাব নিয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য উদ্ধার করা কঠিন; কোন কোন হিসাবে ৫৮টি, আবার কোথাও উল্লেখ করা হয়েছে ৫২টি, আবার কোথাও ৪৩টি।এর মধ্যে বেশীরভাগ খাল রক্ষণাবেক্ষণ করে থাকে ওয়াসা, ডিএনডি বাঁধ এলাকার কিছু খাল পানি উন্নয়ন বোর্ডের আওতায়।বাকিগুলো বিলীন হয়ে গেছে।যেগুলো ক্ষীণ ধারায় এখনো জীবিত আছে সেইগুলোও শহরের চারিপাশে প্রবাহিত নদীগুলোর সাথে সংযোগ হারিয়ে ফেলেছে।শহরের জলাবদ্ধতা নিরসনে বিভিন্ন সরকারের আমলে দেশি-বিদেশি বহু বিশেষজ্ঞ কাজ করেছেন, মোটা মোটা ভলিয়্যুমে রিপোর্টও দিয়েছেন, তাদের পরামর্শ মোতাবেক সব সরকারই কাজ করেছে, কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি।তাই বিরোধী দলও এই সমস্যাটি নিয়ে বড় গলায় আওয়ামী লীগ সরকারকে দোষারোপ করতে পারছে না।আওয়ামী লীগ সরকার দীর্ঘদিন এক নাগাড়ে ক্ষমতায় থেকেও কেন এই সমস্যার সমাধান করতে পারলো না তা বোধগম্য নয়।আমাদের ধারণা খালগুলো ভরাট হওয়ার কারণে জলাবদ্ধতা বাড়ছে।কয়েকটি খাল সরকারের পক্ষ থেকে বক্স-কালভার্ট, রাস্তা ও স্যুয়ারেজ লাইনে পরিণত করা হয়েছে, খালগুলি ভরাট করে যুগ যুগ ধরে ভবন, রাস্তা-ঘাট, ব্রিজ, কালভার্ট, বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ও ড্রেন বানানো হয়েছে।
জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে জনবসতি গড়ার আবশ্যকতা দেখা দেয়, বাড়তি জনসংখ্যার বাড়তি আবর্জনা ফেলার একমাত্র জায়গা নদী, খাল ও জলাশয়।বিভিন্ন নগরীর খাল, বিল ও জলাশয় ভরাট হওয়াই জলাবদ্ধতার মূল কারণ।খালগুলো রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্তৃপক্ষের চরম অবহেলা, উদাসিনতা ও দুর্নীতির কারণেই সরকারের মালিকানাধীন খালে গড়ে উঠেছে ব্যক্তিগত মালিকানাধীন ভবন, কারখানা, মাদ্রাসা, মসজিদ, মন্দির।চোখের সামনে দিনেদুপুরে খালগুলো ধীরে ধীরে প্রভাবশালীদের দখলে চলে গেল- কর্তৃপক্ষ সম্ভবত ঘুষ খেয়ে দেখেও না দেখার ভান করলো।খালগুলো গেল কই- পাকিস্তান আমল থেকে আজ পর্যন্ত কোন সরকার এর জবাব চেয়েছে বলে মনে হয় না; জবাব চাইলে তো দায়ী দুয়েকজনের শাস্তি হওয়ার কথা, খালের রক্ষণাবেক্ষণে দায়িত্বে অবহেলার জন্য কোন সরকারের আমলে কারো শাস্তি হয়েছে এমন কথা শোনা যায়নি।
নদী, নালা, খাল, বিলে জলাবদ্ধতার প্রধান কারণ হিসেবে পলিথিনের ব্যবহারকে দায়ী করা হয়।পলিথিন পচে না।জাপানের কৃত্রিম তন্তু আবিস্কারের পর থেকেই পাটের ব্যবহার কমেছে, পলিথিনের ব্যবহার বেড়েছে।পলিথিনের ব্যবহার নিষিদ্ধ করে বহু আইন হয়েছে, তৎকালীন মন্ত্রী প্রয়াত শাহজাহান সিরাজকে পলিথিন ধরার জন্য বাজারে বাজারে ছুটতে দেখেছি।পাগলামি।পৃথিবীর আর কোন্ দেশে পলিথিন নিষিদ্ধ তা আমার জানা নেই, বিদেশ থেকে যারাই আসেন তাদের হাতে কারুকার্য খচিত পলিথিন দেখা যায়।প্রকৃতপক্ষে পলিথিন ব্যবহারের জন্য জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয় না, জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয় ব্যবহারের পর যত্রতত্র পলিথিন নিক্ষেপ করার কারণে।পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোতে কোন আবর্জনা রাস্তায় ফেলা যায় না, ধরতে পারলে জরিমানা।মানুষও ওখানে সচেতন।আমার ইমিডিয়েট বড় ভাই ড. মুনির উদ্দিন আহমেদ পিএইচডি করেছেন জার্মানিতে, তার কাছে শোনা ঘটনাটি এমন, এক পাকিস্তানি বাদাম খেতে খেতে ফুটপাত দিয়ে হাঁটছিলো আর বাদামের খোসা যত্রতত্র ফেলছিলো, হঠাৎ একটি কিশোরী দৌঁড়ে এসে বললো, ‘এক্সকিউজ মি, আমার আম্মু আপনাকে খোসাগুলো রাস্তা থেকে তুলে ডাস্টবিনে ফেলতে বলেছেন’।আর আমাদের দেশে শিক্ষিত নাগরিকগণও যেখানে সেখানে আবর্জনা ফেলতে একটুও দ্বিধা করেন না।অবশ্য জনগণও যে দায়ী তা কিন্তু নয়, ফুটপাতে কোন ডাস্টবিন নেই; একবার ফুটপাতে ডাস্টবিন দেয়া হয়েছিলো, কিছুদিন পর সবগুলোই ‘নাই’ হয়ে যায়।এমন একটি দেশে আমাদের বসবাস যেখানে ডাস্টবিনও শিকল দিয়ে বেঁধে রাখতে হয়।
ঢাকা শহরে সামান্য বৃষ্টিতেই ভয়াবহ জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়, জনজীবনে নেমে আসে চরম বিপর্যয়।১৯৭৪ সনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ার জন্য ফেনীর প্রত্যন্ত এলাকা জিএমহাট থেকে ঢাকা শহরে প্রবেশ করি; তখনও এমন জলাবদ্ধতা দেখেছি।১৯৮৭ সনে নটরডেম কলেজের কমিউনিটি সেন্টারে আমার বিয়ের অনুষ্ঠান হওয়ার কথা জানিয়ে নিমন্ত্রণ পত্র বিলি করা হয়েছিলো, নটরডেম কলেজের সম্মুখে বুক পরিমাণ পানি থাকায় ওখানে আর অনুষ্ঠান করা যায়নি।ভ্যানে চড়ে বহু বছর বর্ষাকালে চাকুরী করতে বাংলাদেশ ব্যাংকে গিয়েছি।এরশাদ সাহেবের আমলে মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকা থেকে মেশিন দিয়ে পানি সেচতে দেখেছি।গুলশান বনানীর কূটনৈতিক এলাকা বহুবার পানিতে ডুবেছে।প্রতি বছরই যাত্রী রিক্সা থেকে পড়ছে, ঔৎসক্য মানুষ মোবাইলে ছবি তোলে তা ফেইসবুকে দিচ্ছে।ডুবন্ত রাস্তায় চলন্ত গাড়িতে সৃষ্ট ঢেউয়ের ভিডিও পোস্ট করে শিরোনাম দিচ্ছে, ‘এটা কক্সবাজারের সমুদ্র সৈকত নয়’।পানি বিটুমিনের প্রধান শত্রু, পানিতে ডুবলেই রাস্তার বিটুমিন উঠে যায়, গাড়ি চলাচল করলে বিটুমিন দ্রুত নষ্ট হয়, কোটি কোটি টাকায় নির্মিত রাস্তার ধ্বংস রোধ করার কোন উপায় থাকে না।গাড়ির চলাচলে বড় বড় গর্তের সৃষ্টি হয়, পানির মধ্যে ডুবন্ত গর্তগুলোতে পড়ে গাড়ি ভাঙ্গছে, যাত্রীদের হাত-পা মচকাচ্ছে।
আমাদের একটি বদ্ধমূল ধারণা, বৃষ্টির পানিতে শুধু বাংলাদেশের শহরগুলো ডুবে।মুষলধারে বৃষ্টি হলে পৃথিবীর সমতলভূমির অধিকাংশ শহরে সাময়িক জলজটের সৃষ্টি হয়; কারণ অল্প সময়ে অধিক পানি সরার ব্যবস্থা করা সম্ভব হয় না।তবে ঐ সকল শহরের পানি দ্রুত সরে যায়, কিন্তু আমাদের শহরগুলোর পানি বহুক্ষণ স্থবির হয়ে থাকে।ঢাকা শহরে সর্বত্র কংক্রিটের ঢালাই, মাটির উন্মুক্ত এলাকা খুব বেশী নেই।এজন্য বৃষ্টির পানি ভূগর্ভে প্রবেশের কোন সুযোগই পায় না।
পৃথিবী দিন দিন উষ্ণ হচ্ছে, জমে থাকা বরফ গলছে, বরফ গলা পানি নদী হয়ে সাগরে যাচ্ছে, সাগরের পানির উচ্চতা বাড়ছে।বাংলাদেশ, মালদ্বীপের মত নিচু দেশগুলো এক সময় সাগরের পানিতে ডুবে যেতে পারে বলে পরিবেশবিদেরা মনে করছেন।বর্ষাকালে নদীর পানি বেড়ে দুইকুল প্লাবিত করে থাকে, নদী ভরাট থাকে বিধায় প্রায় সমান উচ্চতার ঢাকা শহরের পানি সরার পথ পায় না, বেড়ি বাঁধ দিয়ে শহর রক্ষার ব্যবস্থা করা হয়, ভেতরের পানি শক্তিশালী পাম্প দিয়ে বাইরে ফেলতে হয়।এই কারণে মাটির নিচে বিরাট বিরাট পাইপ বসিয়েও সুফল পাওয়া যাচ্ছে না।তবে লুপ্ত খালগুলো উদ্ধার ও খনন করে শহরের চারিদিকের বড় নদীগুলোর সাথে সংযোগ করে দেয়া সম্ভব হলে হয়তো আরেকটু দ্রুত পানি সরে যেত।খালগুলো জেলা প্রশাসনের অধীনে, পানি নির্গমণসহ রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব ওয়াসার।খালগুলোর সংস্কার ও পুনরুদ্ধারে ওয়াসা থেকে সিটি কর্পোরেশন নিতে চায়।পানি নিষ্কাশনের দায়িত্ব আবার পানি উন্নয়ন বোর্ড, রাজউক ও ক্যান্টনমেন্ট বোর্ডও পালন করে থাকে।কিন্তু খাল সংস্কার ও পুনরুদ্ধারে বিগত বছরাধিক কাল ধরে চেষ্টা করেও ওয়াসা বা সিটি কর্পোরেশনের কোন সহযোগিতা না পাওয়ার অভিযোগ করেছেন নৌপরিবহণ প্রতিমন্ত্রী।এই টানাটানিতে সেনাবাহিনীকে দিয়ে কাজ করানোর দাবী তুলছে কেউ কেউ।মাঝে মাঝে টাস্কফোর্স করার প্রস্তাবনাও আসে, মাস্টার প্ল্যানের কথাও শোনা যায়।আর কত?
পৃথিবীর অধিকাংশ শহরের সৌন্দর্য বৃদ্ধিতে শহরের মাঝখান দিয়ে বয়ে যাওয়া দুর্গন্ধমুক্ত স্বচ্ছ পানির এক বা একাধিক নদীর অস্তিত্ব অপরিহার্য।খালগুলোর পানি দুষণমুক্ত করে দুই পাশে দৃষ্টিনন্দন প্রাকৃতিক পরিবেশ ও হাঁটার রাস্তা থাকলে ঢাকা পৃথিবীর অন্যতম সৌন্দর্যমণ্ডিত শহর হতে পারত।দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলো দীর্ঘদিন খালগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ না করে একে অপরের উপর দোষ চাপিয়ে নিজেদের দায়িত্ব এড়িয়ে চলছে। খাল নিয়ে কূট রাজনীতি না করে সমন্বিত উদ্যোগ নেয়া হলে অনেক আগেই হয়তো ঢাকা শহরের জলাবদ্ধতার অবসান হতো।স্থানীয়
সরকার মন্ত্রী খাল সংস্কারের কর্তৃত্ব সিটি কর্পোরেশনের কাছে হস্তান্তর করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন সত্য, কিন্তু বাস্তবায়ন তত সহজ নয়, আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় কোন কাজ আন্তরিকতার সাথে দ্রুত সম্পন্ন হয় না।বাংলাদেশে দুর্নীতির চেয়ে প্রক্রিয়া ও পদ্ধতির জটিলতা, জবাবদিহিতার অভাব এবং কাজ করার অনীহা বেশী ক্ষতিকর।যখন মাদকে সমস্ত দেশ ছেয়ে যায় তখন ক্রসফায়ার শুরু হয়, যখন জঙ্গিরা টার্গেটেড গ্রুপকে নাঙ্গা তলোয়ার দিয়ে আঘাত করার সক্ষমতা অর্জন করে তখন জঙ্গি দমনের তোড়জোড় শুরু হয়, ঘুষের টাকায় ভবনের পর ভবন নির্মাণের পর দুর্নীতির খতিয়ান প্রকাশ পায়, যখন বর্ষা মৌসুমে রাস্তা-ঘাট, ফুটপাত পানিতে ডুবে যায় তখন দফায় দফায় সভা হয়, সভা থেকে বেরিয়ে পরের বছরে পানি হবে না মর্মে প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়, বর্ষা গেলে খালের কথা, ফুটপাতে উপচে পড়া পানির কথা নীতি নির্ধারকেরা বেমালুম ভুলে যান।আবার প্রথম থেকে শুরু।তাই আমাদের অফিসের ড্রাইভার ওয়াহিদুজ্জমান বলতেন, ‘ স্যার, আমাকে ক্ষমতা দেন, আমি দেশ এর চেয়ে ভালো চালাবো’।
লেখক বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী
পরিচালক ও সিকিউরিটি প্রিন্টিং কর্পোরেশনের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক
ahmedzeauddin0@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.