Header Ads

প্রেমের একাল সেকাল _ অমিত গোস্বামী


প্রেমের একাল সেকা
ক্লাস টেন থেকে ভাবনা, ক্লাস ইলেভেনে উঠে প্রেমের পুরকি জাগে নি এমন বাঙালি সংখ্যালঘু। টেকনিকাল সমস্যা থাকা বা বাপের প্যাঁদানিকে যমের মত ভয় করা ছেলে ছাড়া বাকিরা এ সময়ে বেশ পৃথ্বীরাজ হয়ে উঠত। তখন ছিল চিঠির যুগ, কবিতার যুগ আর বাকিটা ন্যাকামির যুগ। ‘ তুমি তা জানো না কিছু—না জানিলে,/ আমার সকল গান তবুও তোমারে লক্ষ্য করে।‘ যাচ্চলে, সে জানল না, তবে প্রেম হবে কী করে ! মহা ফ্যাচাং। চিঠি লেখা রিস্কি। যদি গার্জেন কমপ্লেইন হয় ! হাবু আবার দূর্গাপুজোয় অঞ্জলি দিতে গিয়ে স্রেফ মাথায় ফুল ছুঁড়ে পাড়ার দূগগাকে তুলে নিল। গজা কালিপুজোয় সিদ্ধি খেয়ে মালাকে বলে দিল – ভালবাসি। মালাও উঠে গেল। পড়ে রইল কৃষ্ণকলি। ওদের বাড়ির পাশে ফুটবল খেলে বা পাড়ার মাচায় গান গেয়েও কিছু হল না। ওর বাবা আবার আমাদের বাংলার টিচার। বুদ্ধদেব গুহ’র মাধুকরীর একটা পরিচ্ছদ টুকে ‘প্রেম ও বিষাদ’ নাম দিয়ে ওর বাবাকে দিলাম – স্যার, একটু রচনাটা দেখে দেবেন? তার পরের ঘটনাটা আমাকে এই সিদ্ধান্তে নিয়ে এল যে বাংলার টিচাররা বড্ড আনরোমান্টিক। বুদ্ধদেব গুহ’র রচনাকে দশে চার দিল।
এখন বুঝি যে সেদিনের মানে সেকালের প্রেম ছিল আলো আঁধারির দীর্ঘশ্বাসে ভরা। “Love is a smoke and is made with the fume of sighs” - প্রেম একটি ধোঁয়া মাত্র যা সৃষ্টি হয় দীর্ঘশ্বাস থেকে- রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েট’-এর একেবারে গোড়ায় এ কথা বলেছিলেন স্বয়ং শেক্সপিয়র। রোমিও আর জুলিয়েটের মতো প্রথম প্রেমের নজির বিশ্বসাহিত্যে খুব কমই আছে। প্রথম প্রেম। শব্দবন্ধটা শুনলেই একটা চমৎকার ঘুমভাঙা সকাল, একটা পাটভাঙা জামার খসখসে মিঠে গন্ধ, একটা হাতে-লেখা চিঠির সারপ্রাইজ ভিজিট। প্রথম প্রেম ভাবলেই একখানা অপার্থিব মুখ, যার দিকে তাকিয়ে থাকাই জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য, দুটো আশ্চর্য হাত, যার মুঠোর ভেতরে পৃথিবীর সেরা নিশ্চয়তা লুকনো, আর একটা অলীক কণ্ঠস্বর, কেবল যেটার জন্যই আমার নামটা রাখা হয়েছিল কখনও। এই ছিল তখনকার প্রেম। উত্তম সুচিত্রার হিট জুটির সিনেমা মানেই এই ধুলোর ছদ্মবেশে গোলাপি আবির মার্কা প্রেম যা হাতের মুঠোয় ঝিনুকের মতো পড়ে থাকে। প্রেম নিয়ে লেখেননি এমন কবি মেলা ভার, প্রেমের ছবি আঁকেননি এমন চিত্রকরও দুর্লভ। শিল্পীদের একটা সুবিধে আছে, তারা যেটুকু আড়াল করবার, সেটুকু লুকিয়ে রেখে বাকিটা প্রকাশ করে ফেলতে পারেন। এতে শ্যামও থাকল, কুলও গেল না। কিন্তু বাকিদের কষ্ট বোধহয় আরও বেশি। আগেকার দিনে তারা প্রেমে দাগা খেলে কিছুদিন দেবদাসের কালাশৌচ পালন করতেন। নয়ত ধর্মযাজক বা সমাজ সংস্কারী হয়ে যেতেন। কেউ কেউ বিয়ে করতেন না। কেউ বা আবার সন্ন্যাস নিতেন। কী মহিমা প্রেমের!
আসলে প্রেমের মহিমা ট্র্যাজেডিতে। ট্র্যাজেডি। মানুষ তো আজীবন ট্র্যাজিডিকেই সেলিব্রেট করেছে। কী শিল্পে, কী জীবনে। যা জীবনে সফল, স্মৃতিতে বা শিল্পে তার দাম মেলেনি। তাই ‘রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েট’ থেকে ‘কয়ামত সে কয়ামত তক’ আমরা মেতে থেকেছি বিচ্ছেদের আরাধনায়। পথ যেখানে আলাদা হয়ে যাচ্ছে, সেখান থেকেই তো রাস্তা শুরু। আমরা কে না জানি মার্গারিটের কথা? আইওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক লেখক কর্মশালায় এক বছর থাকার সুবাদে সেই ফরাসি তরুণীর সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়েছিল দুর্দান্ত যুবক সুনীলের। সে-কথা সুনীলদাই পরে লিখেছেন বহু জায়গায়। পরস্পরকে ভালবেসে ফেলেছিলেন তাঁরা। কিন্তু একসঙ্গে থাকা হয়নি বাস্তবিক কারণে। থাকা হয়নি মানুষদুটোর। কিন্তু ভালবাসাটা ছিল। আর এই বিচ্ছেদ সুনীল’দাকে দিয়ে লিখিয়েছে বিভিন্ন কবিতা ও উপন্যাস ‘সোনালী দুঃখ”। সেই সুনীলই যখন ‘প্রথম আলো’ লিখছেন, তখন তার পাতায় পাতায় উঠে আসছে কাদম্বরী দেবীর প্রতি রবিঠাকুরের অন্ধ মুগ্ধতা আর নির্ভরতার কথা। বৌঠানের অকালপ্রয়াণের পর রবির হাজারো লেখায় তাঁর ছায়ার ফিরে ফিরে আসার কথা। তার পরেও রবীন্দ্রনাথ ভালবেসেছেন, আর সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু অত গভীর ছায়া আর কোনও সম্পর্ক ফেলতে পেরেছে কি? সম্ভবত পারেনি। তিনিও সারাজীবন বিচ্ছেদের উৎসবে মেতেছেন।
সময় পাল্টেছে। টিভির বিজ্ঞাপন বলে, প্রেম ভেঙেছে তো কী হয়েছে, মুভ অন। সময়টাকে কব্জিতে বেঁধে রাখো। আর ‘চন্দ্রবিন্দু’ বলে, “যদি বলো আড়ি, তোমাকেও ছেড়ে যেতে পারি”। বিষাদের উদযাপনের জায়গাটা হয়তো বেপরোয়া হাইওয়েতে এসে দাঁড়িয়েছে। চল্লিশ পেরিয়ে যাওয়া রতনদার কোনও উচ্চাকাঙ্ক্ষা ছিল না। বরং আকাঙ্ক্ষা ছিল এককালে, একজনের জন্য। সেটা পূর্ণ হয়নি বলেই রতনদা না-পাওয়া মেয়েটির জন্য অপেক্ষা করেছে সারাজীবন। এখনো করছে। অথচ রতনদা জানে মেয়েটি কোনও দিন ফিরবে না। কিন্তু জানা আর মানা, মানে মেনে নেওয়ার মধ্যে পৃথিবী আর চাঁদের দূরত্ব। তাই রতনদা এখনও চিঠি লেখেন তার হারিয়ে যাওয়া প্রেমিকাকে। এখন পোস্টাল সার্ভিসেরও ভগ্নদশা। রতনদা সে চিঠি পাঠান কোন ঠিকানায় জানি না। শুধু জানি তিনি লেখেন। প্রথম যুগে চিঠির মাধ্যমে জানানো হতো ভালোবাসার নিবেদন। তখন পোস্ট অফিসের ডাকপিয়নের কদর ছিল আকাশচুম্বি। আগেকার যুগে প্রেমিক-প্রেমিকার যোগাযোগ বা প্রেম নিবেদনের সবচেয়ে জনপ্রিয় ও বহুলপ্রচলিত মাধ্যমও ছিল চিঠি আদান-প্রদান। মুখ ফুটে সরাসরি প্রেমের আবেদন জানানোর সাহস না করে চিঠির মাধ্যমে প্রেম নিবেদন করে অপেক্ষার প্রহর গোনা হতো প্রতিউত্তরের। এতে নানা ধরনের মুখরোচক ও আবেগময় লেখা থাকত। প্রেমের চিঠি আদান-প্রদানের সময় বন্ধু বা বান্ধবীর প্রতিবেশী বা সমমনা বন্ধু-বান্ধব অথবা বাড়ির ছোট ছোট ইচড়েপাকা কিশোর-কিশোরীকে ব্যবহার করা হতো এবং এ কাজের জন্য তাদের নানান ধরনের পুরস্কারেও ভূষিত করা হতো। প্রেমিক বা প্রেমিকা চিঠি পেয়ে সাড়া দিলে তখনি চিঠির উত্তর দিয়ে চিঠি চালাচালির মাধ্যমে প্রেমের প্রথম পর্ব শুরু হতো। আবার অনেকে প্রেম প্রত্যাখ্যান করলে চিঠি ছিঁড়ে বা পুড়িয়ে ফেলত। বাহকের কাছ থেকে যে কোনোভাবে জায়গামতো না গিয়ে অভিভাবক বা মুরব্বি কারও হাতে চিঠি গেলে বিচার-আচার কিংবা ঝগড়াঝাটি-মারামারিও হতো। অনেকেই নিজে চিঠি লেখার বা লেখানোর পরও বার বার পাঠ করে শুনতেন বা শোনাতেন যাতে কোনো তথ্য অসম্পূর্ণ না থাকে। চিঠি লেখার কলাকৌশল, উন্নত ও আবেগময় ভাষা শেখার জন্য বাজারে রং-বেরঙের ছোট ছোট বইয়ের কদর ছিল।
এখন এসেছে চ্যাটিং। ইন্টারনেটের মাধ্যমে স্বল্প খরচে চ্যাটিং করা যায় এবং উভয় উভয়ের আলাপ সরাসরি শোনার পাশাপাশি দেখতেও পারে ওয়েব ক্যামেরার মাধ্যমে মনিটরের পর্দায়। ফেসবুকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বাতচিত করা যায়। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির দ্রুত বিকাশের ফলে বর্তমানে ইন্টারনেট, ই-মেইল, ভয়েস মেইল, চ্যাটিং, ফোন ও মোবাইলের যুগে আজ তা ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে। জাদুঘরের বন্ধ খাঁচার দিকে ক্রমেই ধাবমান আর ইতিহাসের পাতায় বন্দি হওয়ার মতো অবস্থা। ই-মেইল, ফেসবুক, টুইটার, এসএমএস, মাল্টিমিডিয়া মেসেজ, ফ্লাশ মেসেজ, অডিও মেসেজ, টেলিকানেকশন ও মোবাইলের জয়-জয়কারে দেশ-বিদেশের স্বজনদের সঙ্গে পত্র যোগাযোগ এখন সেকেলে মডেলে পরিণত হয়েছে। এখন প্রেম ভালোবাসা, রিলিয়েশন যেনো রাস্তার চার আনা লজেন্স এর মত সস্তা হয়ে গিয়েছে...এই চাইলাম ভালোবাসলাম, আবার হুট হাট ব্রেকাপ করে ফেললাম..এখন আবার অনেকে ব্রেকাপ পার্টিও দেই.. সেই ছবি ফেসবুকে আপলোড দিয়ে বিজয়ের হাসি দেয় । ফেসবুক, টুইটার, ইনস্টাগ্রামে নিজের ভালবাসার মানুষকে কমপ্লিমেন্ট দিয়ে প্রেমের ঘোষণা করছেন সেলিব্রিটিরা। চোখে চোখ, হাতে হাত, ঠোঁটে ঠোঁট মেলাবার জন্য যারা লোক-লজ্জার তোয়াক্কা করে না,তাদের বলা হয় পিডিএ (পাবলিক ডিসপ্লে অফ অ্যাফেকশন)যুগল।. আর তারই আপডেটেড সংস্করণ ভিডিএ (ভার্চুয়াল ডিসপ্লে অফ অ্যাফেকশন)। পার্টনারের সঙ্গে কোনও ঘনিষ্ঠ মুহূর্তের ছবি। সঙ্গে প্রেমে গদগদ দু-চার লাইন, আপনার প্রিয়তম বা প্রিয়তমার উদ্দেশে। এ ভাবেই নতুন প্রজন্ম বলছে,‘ম্যায়নে প্যার কিয়া! হিন্দিতে বলে, ‘প্যার কভি কভি দিখানা ভি পরতা হ্যায়!’ দেখনদারির নেশায় তো বুঁদ আজকের প্রজন্ম। সোশ্যাল মিডিয়ায় আটকে গিয়েছে জীবনের প্রতিটি অভিজ্ঞতা, মুহূর্ত, অনুভুতি। সেই ইন্দ্রজাল ভেদ করার সাধ্য কি আছে ভালবাসা ও তার বহিঃপ্রকাশের?জেন ওয়াই প্রজন্মের যারা এই ট্রেন্ডের সঙ্গে অভ্যস্ত, তাদের প্রত্যেকেরই প্রথম ও শেষ জবাব ‘‘ভাল লাগে, তাই করি।’’ কেন করি তার কারণ তলিয়ে দেখার অবসর নেই। তবে যুক্তি নানা জনের নানা রকম।জেন ওয়াই প্রজন্মের যারা এই ট্রেন্ডের সঙ্গে অভ্যস্ত, তাদের প্রত্যেকেরই প্রথম ও শেষ জবাব ‘‘ভাল লাগে, তাই করি।’’ কেন করি তার কারণ তলিয়ে দেখার অবসর নেই। তবে যুক্তি নানা জনের নানা রকম। হিন্দিতে বলে, ‘প্যার কভি কভি দিখানা ভি পরতা হ্যায়!’ দেখনদারির নেশায় তো বুঁদ আজকের প্রজন্ম। সোশ্যাল মিডিয়ায় আটকে গিয়েছে জীবনের প্রতিটি অভিজ্ঞতা, মুহূর্ত, অনুভুতি। সেই ইন্দ্রজাল ভেদ করার সাধ্য কি আছে ভালবাসা ও তার বহিঃপ্রকাশের? জেন ওয়াই প্রজন্মের প্রেমের রঙ বড় বিচিত্র! প্রেম হয় যত তাড়াতাড়ি, রিলেশনশিপ স্টেটাস বদল হয় তার চেয়েও দুরন্ত গতিতে। কিন্তু যব প্যার কিয়া তো ডরনা ক্যা! প্রেম যখন করেছি তখন খুল্লাম খুল্লাই করব, এমনটাই মত বেশিরভাগের।
তবে প্রেমের রঙ বদলালেও, বদলায়নি জেন ওয়াই প্রেমিকের দাবি। শুধু মনের মানুষের মণিকোঠায় নয়, নাম যেন লেখা থাকে দুনিয়ার দরবারে। আর সোশ্যাল মিডিয়া তো বিশ্বায়িত দর্শকের নামান্তরই বটে! শেক্সপীয়রের নাটকে নায়ক অর্ল্যান্ডো গাছের গুঁড়িতে লিখেছিলেন প্রেমিকা রোসালিন্ডের নাম।. সামনে দূর্গাপুজো ! চমকে দিন আপনার প্রেমিকাকে।
এখনো ভাবছেন কী লিখবেন? ব্যানার বানিয়ে টাঙিয়ে দিন পাড়ার প্যান্ডেলে -
করোনাকে আগে হাম/ অর কেয়া কহে/ জানম সামঝা করো !

______________
অমিত গোস্বামী
কলকাতা, ভারত।

No comments

Powered by Blogger.