Header Ads

ভীরু এ মনের কলি _ শামসুন ফৌজিয়ার গল্প



ভীরু এ মনের কলি


আমি নিনাদ, সরকারী চাকুরী করি। শিক্ষা ডিপার্টমেন্টে, জেলা শিক্ষা অফিসার, যাকে ডি পি ই ও বলে। আমার অনেক দায়িত্ব। সারা দিন কাজে বুঁদ হয়ে থাকি। অনেক সময় ছুটির দিন গুলো তে ও কাজ করতে হয়, অনেক কল রিসিভ করতে হয়, মনিটরিং তো আছেই আর নিজের পেশার প্রতি আমি দারুন রেসপোন্সসিবিলিটি। আমি জানি এই বিভাগে কাজ করা অনেক দায়িত্ব, অনেক বদনাম কুড়ানো। আমি চেস্টা করি আমার দিক থেকে স্বচ্ছ থাকতে এবং প্রচলিত নেতিবাচক মনোভাব দুর করতে। তাই আমি কোন অন্যায়ের সাথে আঁতাত করি না, এ নিয়ে আমার বদনাম আছেই। সবাই জানে নিনাদ একজন রাশভারী লোক। কঠিন ধাতুতে গড়া। কিন্তু এই আবরণের ভেতরের মানুষ টা কে কেউ চেনে না। আজ আমি আমার কথা বলবো। আমার স্ত্রী জলি সেও একটি ব্যাংকে চাকরী করে। একমাত্র মেয়ে নিশাত, সাত বছরের। আমার ছোট্ট সংসার। দুজনে চাকরী করি বলে সংসারে কোন টানপোড়ন নেই। জলি মেয়ে টা খুব ভালো মনের। কাজ শেষে বাসায় নিজেকে সংসারের কাজে উজাড় করে দেয়। আমাদের বিয়ের দশ বছরে আমি কখনো ঝগড়া করেছি বলে মনে হয় না। আমাদের মাঝে চমৎকার বোঝাপড়া আছে । তাই কাজের চাপে বাসায় ফিরতে দেরী হলে ও সে বুঝে আমাকে।

মাঝে মাঝে ভাবি কেন এতো ব্যস্ত থাকি? কত লোক কাজে ফাঁকি দেয় , নির্দিষ্ট সময়ের পরে অফিসে থাকে না। অবৈধ ভাবে উৎকোচ নেয়! সত্যি ভাবতে ঘেন্না লাগে। আমরা পাবলিক সার্ভিসে কাজ করি, নিজের দায়িত্ব যথাযথ ভাবে পালন করলে তো এমন পরিস্হতি তৈরী হতো না। যে যাই করুক বাবা আমি সবার মত হতে পারি না। আমার নীতি কে শিক্ষা কে কলুষিত হতে দেবো না।

সবাই জানে আমি খুব কঠিন একটা লোক। আমার সাথে কথা বলতে কেন যে মানুষ সহজ হতে পারে না? বহু বার ভেবেছি আমাকে মানুষ ভয় পায় কেন? নিজেকে আয়নার সামনে দাঁড় করাই, দেখি আমি তো টিক পথেই হাঁটছি।

গভীর রাতে যখন পৃথিবী ঘুমিয়ে যায় তখন কখনো কখনো আমার ঘুম ভেঙ্গে যায়। উটে এক গ্লাস পানি খাই , বারান্দায় গিয়ে খোলা আকাশ দেখি। কত কথা মনে পড়ে! মাঝে মাঝে জলি এসে কাঁধে হাত রাখে, কিছু বলে না তবে নীরবে আমাকে সায় দিয়ে চলে যায়। এজন্য তাকে মনে মনে ধন্যবাদ দেই । কারণ সে জানে আমার একটা অতীত আছে। হয়তো সেই অতীত ই আমার মুখে কঠোরতার আবরণ মেখে দিয়েছে। মনে পড়ে তাকে, খুব মনে পড়ে। আমার প্রথম ভালোলাগার মানুষ টি কে। আমি ও নুড়ি একই গ্রামের বাসিন্দা ।নুড়ি আমাদের প্রতিবেশী ছিল। একই ক্লাসে পড়তাম, ছোটবেলা খেলাধুলা হৈ হুল্লোড় সব ই করতাম। ভীষন বাকপটু মেয়ে ছিল নুড়ি। আমরা তাকে নুড়ি না ডেকে নেডি বলে ক্ষেপাতাম।

নুড়ি রা পাঁচ ভাইবোন। নুড়ি কে কেন জানি আমার খুব আপন মনে হতো। কত বার একসাথে বকুলফুল তুলতে সাহায্য করেছি, পড়ার জন্য নোট খাতা দিয়েছি, খেলা তে ওঁর জন্য নিজে হেরেছি তবু মনের কথা টা বলতে পারিনি কোন দিন মুখ ফোটে। খেলাতে নুড়ি কে কেউ কিছু বললে আমি ভীষন রেগে যেতাম, যখন বড় হলাম নাইন টেনে তখনো নুড়িকে নিয়ে কেউ বাজে কথা বললে ভীষন খারাপ লাগত। প্রতিবাদ করতাম। তানভীর, মোখলেস রা এ নিয়ে কম হাসাহাসি করত না। আমি দেখলাম চোখের সামনে নুড়ি কেমন যেন বদলে গেলো। সেই পিচ্চি মেয়ে যখন শাড়ী পরত মনে হতো যেন আমার আকাশে হাজার প্রজাপতি উড়ে উড়ে যাচ্ছে। সব সময় নুড়িকে আগলে রাখতাম। মনে পড়ে ঝড়ের রাতে সবাই যখন আম কুড়াচ্ছিলো নুড়ি কোন আম কুড়াতে না পেরে মন খারাপ করে দাড়িয়ে রইল। আমি আমার সমস্ত আম তাকে দিলুম। সে নিতে চায় নি, বলল দেখিস না তোকে আমাকে নিয়ে সবাই হাসাহাসি করে? নুড়ির সাথে আমার বিচ্ছেদ ঘঠে যখন ইন্টার শেষ ঢাকা ভার্সিটিতে চান্স পাই। খুব আশা করে গ্রামে গেলাম নুড়িকে মনের কথা বলবো। কিন্তু বিধিবাম! নুড়ি কে কোন দিন বলতে পারিনি। সুযোগ টা পেলাম ই না। নিজের ভুলের জন্য আজো আমি আফসোস করি! যদি বলতে পারতাম হয়তো সে আমার জন্য অপেক্ষা করত। গ্রামে গিয়ে শুনলাম আমার নুড়ি কোন এক ইউরোপ প্রবাসীর ঘরণী হয়ে গেছে।

কিন্তু এতো ভাবতাম না যদি না এমন ভাবে নুড়ির সাথে দেখা না হতো। সেদিন হাসপাতালে এক কলিগ কে দেখতে গিয়ে এলিভেটরে নুড়ির সাথে দেখা। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম এ কি নুড়ি না অন্য কেউ? রুগ্ন শীর্ণ দেহে নুড়ি যেন এ জীবনের ভার বইতে পারছিল না। ট্রলিতে নার্স নুড়িকে নিয়ে যে রুমে ঢুকলো আমি ও অনুসরন করে গেলাম। পাশে নুড়ির ভাই কে পেয়ে জানতে পারলাম গত রাত নুড়ি একশো টা ঘুমের ট্যাবলেট খেয়েছিল । নুড়ির অচেতন দেহ কে হাসপাতালের বেডে দেখে মনে হচ্ছিল দৌড়ে ছুটে যাই, একটু ছুঁয়ে দেখি! আমার মনে ভেতরে প্রচন্ড কস্ট হচ্ছে। আমি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না আমার হৃদয়ের দেবী কে এভাবে দেখব। ভেবেছিলাম প্রবাসে সে স্বামী সন্তান নিয়ে খুব সুখে আছে।

নুড়ির ভাইর মুখ থেকে জেনেছি নুড়ির স্বামী প্রচন্ড বদমেজাজী আর এক রোখা। সে পার্টি আর মদ নিয়ে থাকত। নুড়িকে ঘরের বাহিরে যেতে দিত না। কারো সাথে যোগাযোগ করতে ও দিত না। মাঝে মাঝে গায়ে ও হাত তুলত। সেইজন্য নুড়ির পেটের বাচ্ছা ও পৃথিবীর আলো দেখতে পায় নি। পনের বছর পরে সুইডেন থেকে নুড়িকে নিয়ে দেশে ফিরে সেই একই আচরণ করতে লাগলো। শ্বশুর বাড়ির লোকেরা ও নুড়ির দিকেই অংগুলি তুলে সায় দিচ্ছিল তার স্বামী ইরফান কে। একটি মাত্র পাঁচবছর বয়সী ছেলে কে রেখে নুড়ি ঐ দিন ঘুমের ঔষধ খেয়ে ঘুমিয়ে গেলো চির দিনের মতো। আমার মনে হচ্ছিল জোরে জোরে কাঁদি হাসপাতালের দেয়ালে মাথা টুকে। শেষমেষ আমার অধরা ভালবাসা কে পরম যত্নে শেষ বিদায় জানাতে হলো। কেউ জানলো না আমার বুকের ভেতর টা কেমন খালি হয়ে গেলো। প্রচন্ড কস্ট হচ্ছিল, ঐ মূহুর্ত মনে হচ্ছিল আমি বেঁচে নেই। আমার জীবনে নেমে এলো বিষাদ! এই প্রথম অফিসে পিওন সহ সবাই কে ধমকাতে শুরু করলাম। এত দিনের হাস্যমুখে কথা বলা মানুষ টা হঠাৎ সবার কাছে আতংকের হয়ে গেলাম। আমি নিজে নিজেই শিউরে উটি মাঝে মাঝে! কি অপরাধ মানুষ গুলোর? কেন তাদের সাথে এমন আচরণ করব? আমার কি সেই রাইট আছে? আমি নরম্যালি কোন ফাইলের জঠিল বিষয় গুলো কে গুরুত্ব দিয়ে সহজ ভাবে সমাধান করতাম। কিন্তু লক্ষ্য করলাম গত একমাসে আমি অন্তত দশ জন শিক্ষক ও কয়েক জন অফিস সহকারী কে শোকজ দিয়েছি। স্ট্যান্ড রিলিজের অর্ডার করেছি। আয়নার সামনে দাড়িয়ে প্রশ্ন করি এ সব কি করছি? ভালো করে ঘাঁটিয়ে দেখি যারা পানিসমেন্ট পেয়েছে তারা সত্যি কোন না কোন অনিয়ম করেছে। আমি আবার রিভিউ করলাম! না টিকই আছে। সবাই কি ভাবে তা নিয়ে মাথা ঘামিয়ে কি করব? আমি তো অন্যায় করিনি। যারা কাজে ফাঁকি দেয় তাদের জন্য এমন চাকরি না করা উত্তম। ব্যক্তিগত অসুবিধা থাকলে ছুটি নিতে পারে বা কর্তৃপক্ষ কে জানাতে পারেন। গত মাসিক মিটিংয়ে বলে দিয়েছি এসব কথা। কেউ কি ভাববে যে একজন দায়িত্ববান অফিসার ও একজন মানুষ? রক্ত মাংসে গড়া। তার জীবনে ও সুখ দুঃখ থাকতে পারে। পারে থাকতে রাগ গোসা। মানুষের জীবনে কত কস্ট থাকে যা কোনদিন কাউকে বলা যায় না।  আমি নুড়ি কে হারিয়ে সত্যি বদলে গেছি। জীবনে স্মোকিং করিনি , এখন সেটা আমার নিত্য সংগী। কেউ কি ভাববে সব মানুষের জীবনে কিছু আঁধার সাইড থাকে। হঠাৎ করে একটা মানুষ কেন বদলে যায়? কেন অদ্ভুত আচরণ করে? আলোকিত মানুষ গুলোর জীবনে ও অনেক ঘঠনা থাকে। অনেক কস্ট থাকে। আমার কস্টের ভাগীদার শুধু আমি। না বলা কথা গুলো আমারে কুরে কুরে খায়। নুড়ি কে না পেয়ে যে কস্ট হয়েছিল তার এই করুণ পরিণতি আমাকে দ্বিগুন কস্ট দিচ্ছে। চিন্তা করতে করতে কখন যে আরাম কেদারায় বারান্দাতে ঘুমিয়ে গেলাম তা টের পাইনি । ঘুমের ঘোরে স্বপ্নে নুড়ি আসল। আমাকে বলছিল, নিনাদ তুই কেন আমাকে বলতে পারলি না মনের কথা? আমি যে তোর জন্যই অপেক্ষায় ছিলাম। কেন আমার ভীরু মনের কলি ফুটিয়ে দিলে না ? যদি তুই আমার জীবনে আসতে তাহলে আজ এভাবে বিদায় নিতে হতো না। নুড়িকে ছুঁতে গেলাম সে অদৃশ্য হয়ে গেলো ।

 

Shamsun Fouzia

New York


No comments

Powered by Blogger.