মীর সাহেবের সরাই ❑ সেলিম ইসলাম খান ❑ ধারাবাহিক উপন্যাস পর্ব_০২
সেলিম ইসলাম খান
❑
উপন্যাস
সিন্ধু নদের তীরে করাচী বন্দর সকাল থেকেই বেশ জাঁকজমকপূর্ণ থাকে। প্রতিদিনের চেয়ে আজ এখানে আরো চারগুণ বেশি হৈচৈ শুরু হয়েছে। এর কারণ বাগদাদের ব্যবসায়ী সৈয়দ আলফা হোসাইনী। তিনি আজ চৌদ্দটি জাহাজের এক বহর নিয়ে কুয়েত বন্দর থেকে করাচী এসেছেন। আরবী, মিশরী, সিরীয় ও তুর্কী পণ্য বিক্রি করে বালুচী, পাঠানী, পাঞ্জাবি ও কাশ্মিরী পণ্য খরিদ করবেন তিনি। হোসাইনী সাহেব সারেং দের কাছে জাহাজের দায়িত্ব দিয়ে তার নায়েবদের নিয়ে বন্দরে অবতরণ করলেন। বন্দরের মসজিদে মাগরিবের নামাজ পড়ে তিনি বাজার ঘুরে দামদর পর্যবেক্ষণ করলেন। তার নায়েবরা স্থানীয় ব্যবসায়ীদের চাহিদা কাগজে লিখে নিচ্ছিল। দুদিন তিনি পণ্য বিক্রি করে পর দিন পণ্য ক্রয় করবেন। দুজন নায়েবকে ক্রয়ের তালিকা করার জন্য বাজারে পাঠিয়ে দিয়েছেন। সকলেই রাত নয়টার মধ্যে জাহাজে ফিরে এলেন। রাতের খাবার খেয়ে ইশার নসমাজ পড়ে হোসাইনী সাহেব নায়েবদের সাথে ব্যবসায়িক মিটিংয়ে বসলেন। রাত এগারোটার মধ্যে মিটিং শেষ করে সবাই বিশ্রামে গেলেন।
পরদিন জাহাজে জামাতের সাথে ফজর নামাজ পড়ে হোসাইনী সাহেব করাচী শহর পর্যবেক্ষণে বের হলেন, সাথে তার সবচেয়ে নিকটস্থ দুজন নায়েব।
শুনশান রাস্তা। কোথাও জন মানবের চিহ্ন নেই। মাঝে মধ্যে রাস্তায় দুএকজন আফগানি, বালুচী ও পান্জাবীকে দেখা গেল। ভোরের আলোয় পাখিরা গাছে গাছে কিচির মিচির সুরে ডাকছে। পথ চলতে চলতে এত ভাল লাগছিল হোসাইনী সাহেব করাচীর একদম উত্তরের প্রবেশ পথে এসে পঠলেন। শহরের ফটকরক্ষীদের সাথে এক পাঠান তরুণের কথাকাটাকাটি হচ্ছিল। ষোল সতেরো বছরের এই তরুণকে বেশ আত্মবিশ্বাসী মনে হল। সে অল্পক্ষণের মধ্যেই দ্বাররক্ষীদের আশ্বস্ত করে কয়েক ডজন গাধার পিঠে কাশ্মীরি শাল আর ইরানী কার্পেট নিয়ে শহরে প্রবেশ করল। এজন্য তাকে খুব সামান্য নজরানা দিতে হয়েছে। অন্য কেউ হলে দশগুণ নজরানা আদায় করে ছাড়তো দ্বাররক্ষীরা। হোসাইনী সাহেব তার কাছে গেলেন। বললেন, কি নাম তোমার বাবা?
পাঠান তরুণ বলল, মীর আব্দুল গফুর খান।
- তোমার বাড়ি কোথায়? আর এসব পণ্য তুমি কোথা থেকে এনেছো?
- আমার বাবা কাপড়ের ব্যবসায়ী ছিলেন। চার বছর আগে তিনি বসন্ত রোগে ইন্তিকাল করেছে। মাথাও এ বছর মারা গেলেন। আমি বাবার ব্যবসাই চালিয়ে যাচ্ছি। এসব পণ্য সীমান্তের বাজার থেকে নিয়ে আসি। করাচী বন্দরে বেশ ভাল দাম পাই। আমার বাড়িও শহরের দক্ষিণ দিকে।
- বাড়িতে কে আছেন তোমার?
- এখন কেউ নেই। বড় বোন ছিলেন। তার বিয়ে হয়েছে আগেই।
-তাহলে এতদূর থেকে গাধার পিঠে করে পণ্য এত কষ্ট করে ব্যবসা করছ কার জন্যে। তোমারতো সামান্য কিঋু রোজগার করলেই চলে।
-রোজগারের জন্য আমি ব্যবসা করছি না সাহাব। কাজের মধ্যে ব্যস্ত থাকার জন্্য করছি।
ঃতোমাকে যদি এর থেকে বেশিলাভের কাজ দিই তুমি কি করবে?
- কেমন কাজ জনাব?
- ধরো জাহাজে দেশবিদেশ ঘুরে আমার ব্যবসায় সহযোগিতা করলে। আমি তোমাকে এর দশগুণ লাভ দেব। পাশাপাশি জাহাজে পড়ালেখার সুযোগও দেয়া হবে।
- দেশবিদেশ ঘোরা আমার ছোট বেলা থেকেই ভীষণ ইচ্ছে। আর পড়ালেখা করাও আমার বেশ পছন্দনীয়। এমন সুযোগ পেলে আমি সত্যিই বেশ কৃতজ্ঞ থাকবো।
- তোমার এই পণ্যসামগ্রীও আমি কিনে নিতে চাই। বন্দরে আমার চৌদ্দটি জাহাজ আছে। আমি জাহাজ নিয়ে বোম্বাই, মালাবার, সিংহল, মাদ্রাজ, কলকাতা হয়ে চিতাগাং ও রেঙ্গুন যাব। তুমি যেতে চাইলে আমাদের সাথে আসতে পার। আমরা তিনচার দিনের মধ্যে রওয়ানা হব।
এর মধ্যে তুমি প্রস্তুতি সেরে নাও আর পরিচিত জনদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে এসো।তৃতীয় দিবসে আলফা হোসাইনী সাহেব পণ্য বিক্রি করে প্রয়োজনীয় পণ্য সংগ্রহ করে জাহাজ বোঝাই করলেন। দেখতে দেখতে নোঙর তোলার দিন এসে গেল। তরুণ মীর গফুর খানকে বিদায় জানাবার জন্য তার আত্মীয় পরিজন এসেছেন। এই অনাথ তরুণকে বিদায় জানাতে এসে আত্মীয়দের অনেকের চোখের কোণে অশ্রুর রেখা দেখা দিল। তাদের থেকে বিদায় নিয়ে জাহাজে উঠলে হোসাইনী সাহেব ও তাঁর লোকজন তাকে বেশ আন্তরিকতার সাথে স্বাগত জানালেন। জাহাজের লোকজনের হাসিমুখ আর আন্তরিকতা দেখে তরুণ মীর গফুর খানের মন আনন্দে ভরে উঠল।
চলবে........
No comments