মীর সাহেবের সরাই ❑ সেলিম ইসলাম খান ❑ ধারাবাহিক উপন্যাস পর্ব_০৯
মীর সাহেবের সরাই
সেলিম ইসলাম খান
❑
উপন্যাস
নিমতলীর উত্তর পাশে
বিশাল একটি তৃণময় সমতলভূমি। তার দুপাশে দুটি উঁচু পাহাড়। গাছগাছালিতে সবুজময় পাহাড়
দুটি যেন জমজ ভাই। উত্তরের খালপাড় থেকে উঁচু হয়ে আবার নিমতলি-র দিকে নিচু হয়েছে।
রমজান আলী খান সাহেব
বললেন, দাদার মুখে শুনেছি, এই পাহাড় সরাইপাড়া হয়ে উত্তরে গিয়ে কৈবল্যধামে
সীতাকুণ্ড পাহাড়শ্রেণীর সাথে মিলিত ছিল। মানুষ নিজেদের প্রয়োজনে পাহাড় কেটে আবাসন
ও চাষবাসের জমি তৈরি করেছে। ফলে পাহাড়ি গাছগাছালির কিছু অবশিষ্ট থাকলেও বেশিরভাগ
গাছপালা কেটে আসবাবপত্র ও জ্বালানির লাকড়ি বানানো হয়েছে।
অশীতিপর রমজান আলী
খানের স্মৃতিচারণা শুনতে শুনতে সুলতানজাদা নসরত শাহ সেনাপতিদের যুদ্ধ প্রস্তুতির
নির্দেশ দিচ্ছিলেন। পরিকল্পনামত তীরন্দাজরাতাদের বাহিনী নিয়ে পাহাড়ে উঠে গেল।
সম্মুখ সারির তীরন্দাজরাও ছুটি খানের নেতৃত্বে সামনে এগিয়ে চলল। কিছুক্ষণের মধ্যে
লাল কাপড় বাঁধা একটি সংকেত তীর এসে ছুটি খানের সামনে পড়ল। ছুটি খান বুঝতে পারলেন,
শাচীনের মগবাহিনী নিমতলী থেকে উত্তর দিকে এগিয়ে আসছে।
ছুটি খান একটুও না থেমে
তার বাহিনী নিয়ে এগিয়ে চললেন। কিছুক্ষণ পর সবুজ কাপড় বাঁধা আরেকটি তীর এসে তার
সামনে পড়ল। ছুটি খান এই তীরের অপেক্ষাই করছিলেন। তিনি দুহাত তুলে মহান আল্লাহর
দরবারে শুকরিয়া আদায় করলেন। তারপর তীরন্দাজদের বললেন, আল্লাহর অশেষ রহমতে দুলালের
তীরন্দাজরা তাদের সামনের সারির মগসেনাদের খতম করতে সক্ষম হয়েছে। এখন তারা গাছের
আড়াল নিয়ে তীর নিক্ষেপ অব্যাহত রেখেছে। তাদের তীরের আঘাতে মগসেনারা প্রাণভয়ে
দিগ্বিদিক জ্ঞানশূণ্য হয়ে পড়েছে। ঐ যে দেখ, আমরা তাূের কাছাকাছি এসে পড়েছি। দেখ
দেখ, তারা কেমন ছুটোছুটি করছে।বিসমিল্লাহ আল্লাহু আকবার তীর নিক্ষেপ শুরু কর
ভাইয়েরা।
ছুটি খানের আদেশ
পাওয়ামাত্র ঝাঁকে ঝাঁকে তীর গিয়ে বৃষ্টির মত আচ্ছন্ন করে ফেলল মগদস্যুদের। এতে
দিশেহারা মগসেনারা বেঘোরে মারা পড়তে লাগল। কিন্তু তাদের পেছনের তীরন্দাজ বাহিনী
পাল্টা তীর নিক্ষেপ শুরু করল। ইতোমধ্যে তারা দুলালদের দিকে পুবের পাহাড় লক্ষ্য করে
তীর ছুড়ছিল। কিন্তু গাছের আড়ালে থাকা দুলালদের কিছুই করতে পারছিল না। এখন সামনে
হঠাৎ বিপদ দেখে তারা সামনেই তীর নিক্ষেপ করতে লাগল। এদিকে গাছের আড়াল থেকে
দুলালদের তীরবৃষ্টি অব্যাহত থাকায় তাদের প্রচুর প্রাণহানি হতে লাগল। কিন্তু তাদের
কিছু তীর এসে ছুটি খানদের অগ্রবর্তী দলকে আঘাত করছিল। কিন্তু তারা একটুও পিছু না
হটে ডাল দিয়ে তীরের আঘাত ঠেকিয়ে তীর ছুড়তে ছুড়তে এগিয়ে চলল। এরা ছুটিখানের
সার্বক্ষনিক সঙ্গী জানবাজ সেনাদল।
সমতলে ছুটি খান ও পুবের
পাহাড় থেকে হঠাৎ আক্রমণ শাচীন কল্পনাও করতে পারেনি। তারা প্রাণ বাঁচাতে পশ্চিমের
পাহাড়ের দিকে ছুটতে লাগল। কিন্তআলিম খানের তীরন্দাজরা ততক্ষণে পশ্চিমের পাহাড়ে
পৌঁছে গিয়েছিল। পলায়নপর মগসেনারা তাদের তীরের আঘাতে এফোড় ওফোড় হতে লাগল। তিন দিক
থেকে বিপদ দেখে তারা তারা এবার পেছনের দিকে পালাতে লাগল। কিন্তু শাচীনের তলোয়ার
বাহিনী পলায়নপর মগতীরন্দাজদের পথ রোধ করে পলায়নে বাঁধা দিচ্ছিল। এতে মগতীরন্দাজ আর
শাচীনের তলোয়ার বাহিনীর মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। এ যেন এক যুদ্ধের মধ্যে আরেক
যুদ্ধের অবতারণা! শাচীনের তলোয়ার বাহিনী নির্দয় মঙ্গল সেনাদের কায়দায় মুখে
উলুধ্বনি দিয়ে ভয় দেখিয়ে তীরন্দাজদের পালাতে বাঁধা দিচ্ছিল। তাতেও পালাতে চাইলে
তলোয়ার দিয়ে কচুকাটা করছিল। এভাবে কিছুক্ষণের মধ্যে শাচীনের সব তীরন্দাজ দল
নিজেদের তলোয়ার বাহিনীর হাতে খতম হয়ে গেল। শাচীন রেগেমেগে তার মৃত তীরন্দাজ
সেনাদের লাশ মাড়িয়ে তলোয়ার বাহিনী নিয়ে ছুটি খানদের দিকে এগিয়ে চলল। দুপাহাড় থেকে
দুলাল আর আলিম খানের তীরন্দাজরা তার অর্ধেক সেনাকে খতম করে ফেলল। বাকি অর্ধেক সেনা
নিয়েই সে ছুটি খানদের মুখোমুখি হল। ছুটি খানের নির্দেশে তীরন্দাজরা ধনু কাঁধে রেখে
তলোয়ার খাপমুক্ত করল। শুরু হয়ে গেল ডালে তলোয়ারে ঝনঝনানি। কিন্তু ছুটি খানের
সেনাদের নিপুণতায় এক ঘণ্টার মধ্যে শাচীনের অবশিষ্ট সেনাও খতম হয়ে গেল। শাচীন ঘোড়া
নিয়ে বন্দরের দিকে পালিয়ে গেল। ছুটি খান আহত সেনাদের চিকিৎসা সেবা দিতে আদেশ দিয়ে
শাচীনের পিছু নিলেন। ছুটি খানের কিছু জানবাজ সেনাও ঘোড়া নিয়ে তাকে অনুসরণ করল।
ততক্ষণে হৈতেন খানের বাহিনীও নিমতলী চলে এসেছিল। হৈতেন খান সেনাদের নিয়ে ছুটি
খানের পিছু নিলেন।
চলবে........
No comments