Header Ads

ধর্ষণের বর্বরতাঃ প্রশ্নবিদ্ধতায় রাজনৈতিক সংগঠন

 

ধর্ষণের বর্বরতা
মুরারি চাঁদ বা এমসি কলেজের ফটকের সামনে নব দম্পতি বেড়াতে যায়, সেখান থেকে জোর করে তুলে নিয়ে কয়েকজন দুর্বৃত্ত স্ত্রীকে ধর্ষণ করে।ধর্ষকদের মধ্যে তিন জন অনিয়মিত শিক্ষার্থী, একজন প্রাক্তন ছাত্র এবং দুইজন বহিরাগত।ছাত্রাবাসের যে কক্ষটির সামনে এই ধর্ষণের ঘটনা ঘটে সেটি নাকি ছাত্রলীগের দখল করা কক্ষ হিসেবে পরিচিত।করোনার জন্য কলেজ বন্ধ, ছাত্রাবাস বন্ধ।তারপরও সন্ত্রাসীরা ওখানে গিয়ে ধর্ষণ করেছে।দখল করা রুমে পুলিশ অস্ত্র পেয়েছে- তাই এই রুমে ধর্ষণসহ আরও কত অপরাধ হয়েছে তা বের করা দরকার।কলেজের প্রিন্সিপালসহ হলের তত্ত্বাবধানে যে শিক্ষক ছিলেন তদেরও রিমাণ্ডে নেয়া দরকার, হল প্রশাসনের নির্লিপ্ততা নিয়ে তাদের বিচার হওয়া দরকার।প্রেমের প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় সাভার পৌরসভার পালপাড়া এলাকায় নীলা রায়কে ছুরি মেরে হত্যা করে মিজানুর রহমান চৌধুরী।ভাইয়ের সঙ্গে রিকশায় করে হাসপাতালে যাওয়ার পথে নীলাকে ছিনিয়ে নিয়ে বখাটে মিজানুর ছুরিকাঘাতে হত্যা করে।ভিন্ন ধর্মের একটি মেয়ের ভালোলাগা, মন্দলাগার কোন প্রশ্ন নেই- মুসলিম ধর্মের মিজান চৌধুরীর পছন্দই ভালোবাসার একমাত্র পরিমাপক।খাগড়াছড়িতে ডাকাতি করার উদ্দেশ্যে ঘরে ঢুকে এক প্রতিবন্ধী তরুণীকে দলবেঁধে ধর্ষণ করা হয়েছে৷গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে এক তরুণীকে দুইদিন ধরে আটকে রেখে দলবেঁধে ধর্ষণের অভিযোগ উঠেছে৷ টাঙ্গাইলের দেলদুয়ারে গত ১৯ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় ১৩ বছরের এক শিশুকে জোর করে তুলে নিয়ে দলবেঁধে ধর্ষণের অভিযোগ উঠেছে।এমন আরও অনেক।
স্বামীর সাথে বেড়াতে গিয়ে যে স্ত্রী ধর্ষিতা হন সেই স্ত্রীর নিরাপত্তা তো ড্রোনের পাহারা বসিয়েও নিশ্চিত করা সম্ভব নয়।ভাইয়ের পাশ থেকে বোনকে ছিনিয়ে নেয়ার সাহস দুর্বৃত্তরা তখনই করে যখন সমাজে চরম অরাজকতা বিরাজ করে।এতদিন পর্যন্ত যত অপরাধীর কথা মিডিয়ায় এসেছে তাদের প্রায় সবাই ধরা পড়ছে, কিন্তু অপরাধী গ্রেফতারের কোন ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া সমাজে প্রতিফলিত হচ্ছে না।কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোর কোন কোন রুম প্রতিপক্ষকে শায়েস্তা করার টর্চার সেল হিসেবে ব্যবহৃত হতে শোনা যায়, কোন কোন রুমে বাইরের লোকদের ধরে নিয়ে নিপীড়ন করে মুক্তিপণ আদায়ের অভিযোগও শোনা যায়।এক্ষেত্রে রাজনৈতিক প্রশ্রয় না থাকলে কারো পক্ষে কোন রুমকে টর্চার সেল হিসেবে ব্যবহার করা সম্ভব নয়।এমন সন্ত্রাসীদের অপরাধের জন্য ছাত্র সংগঠনকে জবাবদিহী করতে হয় না, ছাত্র সংগঠনের সভাপতি বা সেক্রেটারিকে পার্টির তরফ থেকে জেরা করা হয় না।সাংগঠনিক দুর্বলতা না থাকলে নিজেদের কর্মীর অপরাধ সম্পর্কে সভাপতি বা সেক্রেটারির অজ্ঞাত থাকার কথা নয়।প্রতিটি কর্মীর চালচলন, কথাবার্তা নখদর্পনে রাখা জরুরী।কে বিনে পয়সায় খাবার খায়, কে কথায় কথায় নিরীহ ছাত্রদের অপমান করে, কে ছাত্র সংগঠনকে ব্যবহার করে অপরাধ করছে তার হিসাব না থাকলে সৎ ও দৃঢ় নেতৃত্ব সৃষ্টি হবে কী করে? মূল রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেও এমন রাজকীয় ভাব দেখা যায়- থানা ও জেলা পর্যায়ের নেতারা অপরাধ করতে করতে চরম পর্যায় পৌঁছার পর কেন্দ্রিয় নেতার হুঁশ হয়।কেন্দ্রিয় নেতাদের সাথে থানা ও জেলা পর্যায়ের নেতাদের সম্পর্ক রাজা আর প্রজার।কেন্দ্রিয় নেতার সাথে একটি ছবি তুলতে পারলে স্থানীয় নেতারা বর্তে যায়, স্বর্গসুখ লাভ করে।এমন দাসানুদাস সম্পর্কের জন্য রাজনীতি বিকশিত হচ্ছে না, বিকশিত হচ্ছে মাস্তানি আর ধর্ষণ।ক্ষমতাসীন দলের কেন্দ্রিয় নেতাদের হামবড়া ভাবের পরিবর্তন না হলে কর্মীদের স্বচ্ছ রাজনীতির প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি হবে না, নগদ প্রাপ্তির প্রত্যাশায় দুর্বৃত্তপনা মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে।অপরাধীদের ‘কাওয়্যা’ বললে মানুষ গোপাল ভাঁড়ের সুড়সুড়ি ছাড়াই হাসে।
আঠার কোটি মানুষের জন্য বাংলাদেশ একটি ছোট্ট ভূখণ্ড।উন্নয়নের জোয়ারে ভেসে গেলেও এই দেশের মানুষের অভাব যাবে না।তাই এদেশের মানুষ শুধু দুই বেলা ভাত খাওয়ার জন্য নিজের স্ত্রীকে সৌদি আরবসহ মুসলিম দেশগুলোতে গৃহকর্মী হিসেবে পাঠিয়ে থাকে।পরিবারের সদস্যদের মুখে দুটো ভাত তুলে দেয়ার প্রত্যাশায় সৌদি আরবে গিয়েছিলেন কিশোরী উম্মে কুলসুম।কিন্তু এক্ষেত্রে মা-বাবার স্বপ্ন পূরণ হয়নি; তিনি যে পরিবারে গৃহকর্মী ছিলেন সেই পরিবারের লোকেরা তাকে পিটিয়ে মেরে ফেলেছে।সৌদি আরবের মুসলমানদের কাছে ক্রীতদাসী আর গৃহকর্মীর মধ্যে কোন পার্থক্য নেই; তাদের বিশ্বাস, ক্রীতদাসী বিয়ে না করে ভোগ করা জায়েজ হলে গৃহকর্মীও ভোগ করা যাবে।তাই গৃহকর্মী হয়ে যাওয়ার পরদিন থেকেই কুলসুমের উপর শারীরিক ও যৌন নির্যাতন শুরু করে মালিকপক্ষ।সৌদিরা যৌন সম্পর্কে স্থাপনে উদার, একই গৃহকর্মীকে পালা করে বাবা এবং ছেলে ভোগ করে থাকে।যৌন সম্পর্ক স্থাপন করেও তারা তুষ্ট থাকেনি, গৃহকর্তা ও তার ছেলে মিলে কুলসুমের দুই হাঁটু, কোমর ও পা ভেঙে দেয় এবং একটি চোখ নষ্ট করে রাস্তায় ফেলে দেয়।সৌদি আরবের পুলিশ তাকে উদ্ধার করে সেখানকার হাসপাতালে ভর্তি করালেও চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায় কুলসুম।
যারা ভারতের প্রতি নতজানু পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে অহরহ কথা বলেন তারাও সৌদি আরবের বেলায় নিশ্চুপ।তবে গরীব দেশের স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি বলে কিছু থাকতে নেই।আমরা মিসকিন, মিসকিনের আবার স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি! শত শত গৃহকর্মী ধর্ষিত হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে, সৌদি অপরাধী কারো বিচার হয়েছে এমন কথা শুনিনি।ফিলিপিন্স, ইন্দোনেশিয়া প্রভৃতি দেশ সৌদিদের এমন বর্বরতার কারণে গৃহকর্মী পাঠানো বন্ধ করে দিয়েছে, কিন্তু আমরা এত অভাবী যে, লাশের পর লাশ এলেও আমরা স্বেচ্ছায় আমাদের মা-বোন ও স্ত্রীদের বর্বর সৌদি মুসলমানদের ভোগের জন্য মধ্যপ্রাচ্যে পাঠাব।
কোন কোন মনোবিজ্ঞানী মনে করেন, বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে শুধু যৌন তাড়না থেকে যৌন নিপীড়ন হয় না, যৌন নিপীড়ন হয় পৌরষত্ব জাহিরের তাগিদ থেকে; ভাবটা এমন-পুরুষ যা করবে তা নারীরা নিরবে সহ্য করবে, কোন উচ্চবাচ্য করবে না।লালিত সামাজিক রীতিনীতি ছাড়াও অশিক্ষিত মোল্লা, মৌলভীর নারী বিদ্বেষী ওয়াজ-মাহফিল থেকেও পুরুষের পৌরষত্ব জেগে উঠে।তাই তো অনেক পুরুষ নারীর সম্মতির তোয়াক্কা করে না; নারীর সম্মতি নেয়ার বিষয়টি পুরুষের পৌরষত্বের প্রতি আঘাত হানে।এ কারণে অবচেতন দেহে অনেক পুরুষ ধর্ষণ করে পৌরষত্বের অভিব্যক্তি ঘটিয়ে থাকে।এজন্যই পাকিস্তানে গোষ্ঠী দ্বন্দ্বে প্রতিপক্ষের কারো নিরীহ মেয়ে বা মা বা স্ত্রীকে গণধর্ষণ করে প্রতিশোধ নেয়া হয়ে থাকে এবং সমাজ একে পবিত্র কাজ বলে মনেও করে থাকে।যৌন হয়রানীর শিকার নারীরা পুরুষের বিরুদ্ধে বলতে সাহস করে না।কোন মেয়ে একটু সাহসী হলেই বলা হবে, মেয়েরা ঘর থেকে বের হওয়ার দরকার কি, পাকঘরের বাইর হয় বলেই তো সমাজে এত অনাচার; মেয়েদের হতে হবে অসূর্যস্পর্শা, সূর্যের আলো গায়ে লাগানো তাদের জন্য অপরাধ।এই সমাজে নিপীড়িত নারীকে সমাজবদ্ধ হয়ে আরও নিপীড়ন করা হয়।তাই তো ভারতে 'মি টু' আন্দোলনের সূত্রপাত হয়েছে এককালের যে অভিনেত্রীর আগ্রহে সেই অভিনেত্রী তনুশ্রী দত্তকে একদল লোক 'সমকামী' ও 'ধর্ষণকারী' বলে আক্রমণ করে যাচ্ছে।তনুশ্রী দত্তকে শুধু সমকামীই নয়, মাদকাসক্ত বলেও বর্ণনা করা হচ্ছে।
আমাদের দেশে এই মর্মে প্রায় সংবাদ বের হয় যে, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, পাড়ায় প্রেম প্রস্তাবে সম্মতি না দেয়ায় প্রতিশোধ ও প্রতিহিংসায় মেয়ের মুখে এসিড নিক্ষেপ করা হচ্ছে, মেয়েদের রাস্তায় পথচারীদের সম্মুখে হেনস্তা করা হচ্ছে, শত শত লোকের সামনে থাপ্পড় মারা হচ্ছে, কিরিচ দিয়ে কোপানো হচ্ছে ইত্যাদি।হাসপাতালে নেয়ার মতো আঘাত না হলে এসব যৌন হেনস্তা কেউ প্রকাশ করে না, কারণ প্রকাশিত হলেই ঐ মেয়ের আর বিয়ে হবে না, গোপনে বিয়ে হলেও স্বামী প্রবরের কানে গেলে সাথে সাথে তালাকের ঘন্টা বাজবে।এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ৭৫% যৌন হেনস্তার ঘটনা চাপা দেয়া হয়।
ধর্ষণে বলপ্রয়োগ থাকে, প্ররোচনা থাকে, চাকুরী হারানোর ভয় থাকে, কিন্তু মন জয়ের চেষ্টা থাকে না।তাই পীড়িত করা ধর্ষণের মধ্যে যারা তৃপ্তি খোঁজে তাদের চরম শাস্তি দেয়া দরকার।আমোদজনক বিষয় হচ্ছে, যারা ইসলাম ধর্ম নিয়ে যানপ্রাণ, প্রতি মুহুর্তে ধর্মের বিভিন্ন গুণগান গেয়ে পোস্ট দিয়ে থাকেন, কেউ ধর্ম নিয়ে প্রশ্ন করলে মারমার কাটকাট শুরু করে দেন,- তারা কিন্তু নীলা রায় বা কুলসুমকে নিয়ে কোন পোস্ট দিয়েছেন বলে মনে হয় না।ধর্মটা শ্রেষ্ট, কিন্তু দু:খজনক হচ্ছে, ধর্মের লোকগুলো শ্রেষ্ঠ হতে পারলাম না।
লেখক বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ও সিকিউরিটি প্রিন্টিং কর্পোরেশনের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক
ahmedzeauddin0@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.