Header Ads

আংটি _ শামসুন ফৌজিয়ার গল্প


আংটি

তুমুল হট্টগোল আর উত্তেজনার শুরু সেঁজুতির বাড়িতে।মুরব্বীরা কথা বলেই চলছে, সাথে ছোটরা অবাক হয়ে দেখছে।উঠোন ভর্তি লোকজন! কে কার কথা শুনে! সবাই সমান তালে চিল্লাচ্ছে। সাথে সেঁজুতির শ্বশুর, শ্বাশুড়ী দুজনই অভিযোগ পেশ করেই চলছে!
কেউ বলছে ঘাড় ঢাক্কা দিয়ে বের করে দাও। লাজ লজ্জ্যা বলতে কিছু নাই সেঁজুতির ।
উঠোনের এক কোনে দাঁড়িয়ে থাকা সেঁজুতির বাবা প্রানপনে বলেই যাচ্ছেন , দয়া করে মেয়েটির সর্বনাশ করবেন না, আমি খুব শাসন করে দেবো। আমার মাইয়া এমনটি ছিলো না।
এই কথা শুনে সেঁজুতির শ্বাশুড়ির গলা সপ্তমে চড়িয়ে বলল, বেয়াই তুমি নামায কালাম পড়া মানুষ! আর নিজের মাইয়াকে আদব কায়দা শেখাও নাই। এমন মাইয়ার জন্য আমার সোনার ছেলের জীবন নষ্ট অইতে দিমু না।
সেঁজুতির মা বেয়াইনের হাত ধরে বলেন, বেয়াইন মাফ কইরা দাও, মাইয়াটা বুঝে নাই।
সেঁজুতির চাচা শ্বশুর তারুমিয়া বলে উটলেন, শোনো বেয়াই এই বেয়াদব , নষ্টা মাইয়া এখানে রাখা যাবে না। ওরে নিয়া যাও।
সেঁজুতির ননদ মিনা বলে ,আমি নিজের চউকে দেখেছি ভাবি লুকিয়ে লুকিয়ে চিটি লেখে ! আমিনুল ভাইয়ের সাথে ফিস ফিস করে!
সেঁজুতির দু’চোখ বেয়ে দরদর করে জল পড়তে থাকে।
বাড়ি ভরা মানুষগুলো জিন্দা সেঁজুতির রুহের ওপরে অভিযোগ বর্ষন করতেই লাগলো। কোন উপায়ান্তর না দেখে সেঁজুতির ভাই মনির বলল, ঠিক আছে আমার বোনরে নিয়া গেলাম। কিন্তু আমার বোন এমন কাজ করতেই পারেনা।
শেষ পর্যন্ত মনির বোনকে নিয়ে বাড়িতে ফিরল। সারা পথ কারো মুখে রা ছিলো না। আর সেঁজুতি! গত দুদিন ধরে উপোস! দূর্বল হয়ে পড়েছে, ভয়ে মুখখানা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে।
মনির সিএনজি চালায়, দু ছেলের বাপ।অভাবের সংসার। তার ওপর বোনকে নিয়ে আসায় মনিরের বউ খুব রেগে আছে।
সেঁজুতি ভাইয়ের বউর সমস্ত কাজগুলো নিজের দায়িত্ব ভেবে করতে ভুলে না। তার বৃদ্ধ বাবা ও কাজের সন্ধানে রোজই বাইরে চলে যান।
সেঁজুতির বিয়ে হয়েছিল দু’বছর আগে ডুবাই থাকা আবুলের সাথে।ক্লাস নাইনে উঠে তার পড়া হয়নি। বাবা মা আর এক ভাইয়ের বড় আদরের ছিলো।ছোটবেলা হতে তার স্বর্নের আংটি পরার খুব শখ ছিল। কিন্তু গরীব বাবা শখ মেটাতে পারেনি, শান্তনা দিতেন, তোর রাজপুত্রের সাথে বিয়ে হবে, সে তোকে আংটি কেন গা ভর্তি গহনা দিবে।
বিয়ের দু’মাসের মাথায় আবুল ডুবাই চলে যায়, এই দুই বছরে আর আসেনি। যোগাযোগ বলতে ঐ বড় ননদের ফোনে হঠাৎই কথা হয়।স্বামীকে জানার তেমন কোন সুযোগই সে পায়নি। নতুন বিয়ে, ঘরভর্তি মেহমান সব সময়ই ছিলো।সারাদিন ওদের সাথেই আবুলের সময় কাটত। ঘুমোবার সময় আবুলের সাথে যতটুকু কথা হতো এই পর্যন্তই।
আবুল ও চাইত স্ত্রীকে সময় দিতে, কিন্তু সমাজ সংসারের এক অদ্ভুত নিয়মে বেড়ে ওটা আবুল সেই নিয়মগুলোকে উপেক্ষা করতে পারত না।
দেখতে দেখতে তিনমাস চলে যায়, সেঁজুতির শ্বশুর বাড়ির কেউ তাকে নিতে আসেনা।এমনকি আবুলের সাথে ও তেমন কোন যোগাযোগ নেই।সেঁজুতির ভাই অনেক কষ্ট করে ফোনে আবুলের সাথে যোগাযোগ করে। আবুল জানায় সে তার মা বাবার সাথে কথা বলছে, অচিরেই তারা সেঁজুতিকে নিতে আসবে।
সেঁজুতির বাবা মায়ের মনে খুশির বন্যা।শুকরিয়া জানায় রবের দরবারে বিবাদটা মিটিয়ে গেলো বলে।
মনিরের বউ সব সময় খোঁচা দিতেই থাকে সেঁজুতিকে পরপুরুষের সাথে সম্পর্ক! এতো চরিত্রহীন মেয়েকে কেউ মেনে নিবে ?
সেঁজুতি কতদিন এটা শুনে নীরবে কাঁদে। তাঁর সাথের বান্ধবীরা এখনো কলেজে পড়ছে, বিয়ে হয়নি। তারা পড়াশোনা করে চাকরি করবে, বিয়ে করবে। কতো সুন্দর তাদের জীবন। নিজের অজান্তে একটা দীর্ঘশ্বাস বয়ে যায়।আজ যদি তার মা বাবার আর্থিক অবস্থা ভালো হতো সে পড়তে পারত।
সারাদিন ভাইয়ের বউকে কাজে সাহায্য করে, দুবছরের ভাইপোকে দেখভাল করে সময় কেটে যায়।তারপরে ও মনে পড়ে আবুলের কথা। স্বামীকে চেনার সুযোগই হয়নি সেঁজুতির।আবুলের চাচাতভাই ও সমবয়সী আমিনুলের ফোনে মাঝে মধ্যে আবুলের সাথে লুকিয়ে যোগাযোগ হতো।সেই জন্য সেঁজুতির কথা বলতে হতো আমিনুলের সাথে, এটা ননদ দেখে ফেলে। সেই থেকে তার ওপর অত্যাচার শুরু হয়।
সবাই ধরে নেয় মিনা সত্য বলছে আর চাচা শ্বশুর ও নিজের চোখে এই ঘঠনা দেখে ফেলায় সমস্যা বড় আকার ধারন করল। আমিনুল তার বাবাকে বুঝিয়ে বললে ও কেউ তার কথাই শোনেনি।সেঁজুতির চরিত্রে কালিমা লাগাতে থাকে তারা। এরই মধ্যে আবুলের ছোট ভাই ভাবীর গায়ে হাত তুলে। সেঁজুতির নাকে মুখে চড় দেয় সেবুল, চড়ের তোপে তার নাকফুল ভেঙে রক্ত ঝরতে থাকে। উঠোন ভর্তি লোকের সামনে শ্বশুরবাড়ির লোকজন তার মা বাবা ভাইকে অপমান করে ।
সেঁজুতির মনে খুব আক্ষেপ হয় কেন সবাই তাকে ভুল বুঝলো?
এক শুক্রবারে আবুলের বাবা সেঁজুতিকে নিতে আসে।খুশিমনে সে স্বামীর বাড়ি চলে যায়।যাবার আগে মা বাবা , ভাই অনেক বলে দিয়েছে যেন বুদ্ধি করে চলে।
সেঁজুতির দেবর ননদ সবাই তাকে দেখে বলে উটলো, দেখো এবার কোন কান্ড ঘটালে এ বাড়িতে জায়গা হবে না।
সে নীরবে নিজের ঘরে চলে গেলো।তার বড় ননদ মিনা বলল, শোনো ভাবী আমার ভাই সরল মানুষ, তোমাকে বিশ্বাস করে। খবরদার কোন বাজে কাজ করলে কেউ তোমাকে ক্ষমা করবে না।
সেঁজুতি কোন কথা না বলে ঘরের কাজ করতে লাগে। প্রথম সপ্তাহ খুব ভালো কাটলো ।গ্রীষ্মকাল। প্রচন্ড গরম। এ বাড়িতে বিদ্যুতের ব্যবস্থা থাকলে ও সেঁজুতির ঘরে কোন ফ্যান নেই, তাই হাতপাখা দিয়ে বাতাশ করতে থাকে। ছোট ননদ রুনা তার সাথে ঘুমায়।রাত গভীর হলে আবুলের কথা মনে পড়ে। খুব ইচ্ছে হয় স্বামীর সাথে কথা বলতে। মনে পড়ে রাতে লুকিয়ে আমিনুলের ফোনে কথা বলতে গিয়ে এক ধরনের মায়া জন্মে গেছে আবুলের জন্য। দুজনের মধ্যে এক গভীর ভালোবাসার সম্পর্ক গড়ে ওটার মূহুর্তে ধরা পড়ে গিয়ে কত লাঞ্চিত হতে হলো তাকে।
আবুলের টাকায় সংসার চললে ও কেউ তার স্ত্রীর সাথে ন্যুনতম একটা ভালো কথা ও বলে না। সবার ধারনা আবুল সব টাকা বউকে লুকিয়ে দেয়। ননদের ফোনে যখন আবুল কথা বলে তখন সবার সামনেই তার কথা বলতে হয়। তাই মনের আদান প্রদান করা হয় না।
এই সংসারে অদ্ভুত নিয়ম, রান্নাঘরের দুধ, চিনি বা বিস্কুট সব তালাবদ্ধ থাকে। মেহমান আসলে বা তাদের খাবার ইচ্ছে হলে চাবি দিয়ে খুলে মেপে মেপে সেঁজুতির হাতে তুলে দেন শ্বাশুড়ী।
ভাত তরকারী রান্না করতে ও সেই নিয়ম পালন করতে হয়। কম তেলে , কম মশলায় কি করে রান্না টেস্টি হবে সব নিয়মগুলো শিখে নিতে হচ্ছে তাকে। গত দুবছরে সবাইকে আপন করে নিতে গিয়ে ও কেউ তার আপন হয়নি।গরীব বাবা মা ঠিকমত মেয়ের বাড়িতে সামাজিক নিয়মগুলো পালন করতে পারে না বলে কত খোঁটা শুনতে হয়।গ্রীষ্ম কালে আম কাঁঠাল দেওয়া, রোজা মাসে ইফতারী সহ কত সামাজিক নিয়ম আছে। পাশের ঘরের দেবরের শ্বশুরবাড়ি হতে এগুলো আসলে সেঁজুতির কথা শুনতে হয়। নীরবে সহ্য করে যায় সে। কত রাত অভ্যুক্ত থাকতে হয়, সবাই খেয়ে ফেলে তার জন্য কিছু রাখে না।রাতে সেঁজুতির ঘুম লাগেনা, আবুলের কথা ভেবে, আর কিছুদিন পরেই আবুল দেশে আসবে। তার কথা হয়েছে, আবুল বলেছে, ধৈয্য ধরতে। সে আসার সময় সেঁজুতির পছন্দের একটা আংটি আনবে বলেছে।কতদিন বান্ধবী লিজার হাতে আংটি দেখে মনে হয়েছে এরকম একটা আংটি যদি তার থাকত। কিন্তু ঘুম তো লাগেনা ক্ষিধায়, ধীরে ধীরে রান্নাঘরে গিয়ে খাবার জন্য খুঁজতে লাগলো। কিছু না পেয়ে জগ হতে পানি ঢালতে গিয়ে হাত হতে পড়ে শব্দ হলো। শ্বশুর জেগে গেলেন , কে ওখানে? বলতেই দেবর সেবুল জিগ্যেস করলো , কি হয়েছে বাবা ?
শ্বশুর টর্চ লাইট মেলে ধরলেন , সেঁজুতির মুখের ওপর আলো পড়তেই সবাই অবাক! যেন একটা চোর ধরলেন! ইতিমধ্যে ঘরের সবাই জেগে গেছেন।
সেঁজুতি কেঁদে বলতেই লাগলো ,বিশ্বাস করুন আমার খুব ক্ষিধা পাইছিল তাই কিছু না পাইয়া পানি পান করতে গিয়ে জগ পড়ে যায়।
কে শুনে কার কথা? সবাই সন্দেহ করে সেঁজুতি আগের মতো আমিনুলের সাথে দেখা করার জন্য জেগে আছে। ভাগ্যিস ননদ মিনা আজ নেই, না হলে কি না হতো।
সেঁজুতির মনে খুব ঘৃণা চলে আসে। সবাই তাকে ভুল বুঝে।কথায় কথায় চরিত্রহীনা বলে। আবুল যে কবে আসবে? আবুল কতবার ফোনে তার মা বাবাকে বলেছে যে, সেঁজুতি আমিনুলের ফোনে তার সাথে কথা বলতো। কেউ বিশ্বাস করেনি। কত শখ ছিলো একটা আংটি পরে বান্ধবীদের দেখাবে তার স্বামী দিয়েছে।এই সংসারে কাউকে পায়নি তার পক্ষে দাঁড়াতে। সেদিন দেবরের ভাত দিতে দেরী হওয়ায় সামান্য তর্ক করে।ঐ দিন তরকারিতে লবন ও কম ছিলো। সেঁজুতির হুঁশ নেই কি করে! এতো মানসিক নির্যাতনে সে চুপসে গেছে। সেবুল তাকে লাটি দিয়ে পেটায়। আমিনুলের চোখে পড়ায় সে এগিয়ে এসে উদ্ধার করে।ব্যাস এই নিয়ে সালিশ হলো, সালিশে সেঁজুতির সাথে আমিনুলের গোপন সম্পর্ক চলছে বলে তাকে ভরা সালিশে অপমান করা হয়। ভার্সিটি পড়ুয়া আমিনুল প্রতিবাদ করে। কোন কাজ হয়না, তাকে বাবা ভাইর হাতে ধরিয়ে দেওয়া হয়।
হায়রে মেয়ে মানুষ! কোন এক আবুলের সাথে বিয়ে হয়েছিল, কিন্তু স্বামীর বাড়ির সবার অপমান করার অধিকার ছিলো তার ওপর।
আর মাত্র দুদিন পরে আবুল দেশে আসলো। সে সব শুনে মা বাবাকে বলল, সেঁজুতির কোন দোষ নাই, আমি চললাম তাকে আনতে।
কিন্তু শ্বশুরবাড়ি পৌছে আবুল সেঁজুতির খোঁজ পেলো না। পকেটে সেঁজুতির জন্য আংটি রাখা, নিজের হাতে পরিয়ে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে। কিন্তু সেঁজুতির আংটি পরার ভাগ্য নেই। সে দুদিন আগে গলায় দড়ি দিছে। মরে গিয়ে সেঁজুতি বেঁচে গেলো।সারাজীবনের স্বপ্ন আংটি পরার পূরণ হলো না। আবুল হাউমাউ করে কেঁদে উটলো।
Shamsun Fouzia
08/19/2020
New York, USA

No comments

Powered by Blogger.