Header Ads

শান্ত ডাকাত _ ফরিদা ইয়াসমীন নার্গিস


শান্ত ডাকাত
গভীর রাত, শিবলি সাহেব টেবিল লাইটের আলোতে বসে লিখছিলেন। পাশেই খাটে ঘুমে বিভোর তার স্ত্রী। এক ছেলে এক মেয়ে আর স্ত্রী কে নিয়ে সুখের সংসার তার। সরকারি কর্মকর্তা, বাড়িটা সুন্দর সাজানো গোছানো। ছেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়া সদ্য শেষ করল।মেয়েটা দ্বাদশ শ্রেনিতে। শহর থেকে বেশ খানিকটা দূরে ছায়াসুনিবিড় পরিবেশে বিশাল বাড়ি তৈরি করে বাস করছেন পরিবার নিয়ে। শহরের কোলাহল তার একদমই পছন্দ নয়। দিনশেষে তিনি তার শান্তির নীড়ে ফেরার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকেন। পরিবারের সবার মধ্যে এক নিবিড় বন্ধন।
গভীর মনোযোগ দিয়ে লিখছিলেন তিনি। হঠাৎ দরজায় বেশ জোরে কড়া নাড়ার শব্দ। এতরাতে কে আসতে পারে? আশেপাশে বাড়িঘর বেশ দূরে দূরে। এখানে তার বসবাসও বেশি দিনের নয়। পরিচিত যারা আছেন, সবার সাথে মোটামুটি একটা ভাল সম্পর্ক তৈরি হয়েছে শুধু। কারো কি তবে কোন বিপদ হল? ভাবতে ভাবতে তিনি সরল বিশ্বাসেই দরজাটা খুললেন। কিছু বুঝে ওঠার আগেই কাপড়ে মুখ বাধা কয়েকজন লোক ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ল। কোন প্রশ্ন করার সুযোগই পেলেন না। আরে আরে তোমরা কারা? এত রাতে আমার বাড়িতে কেন? বলে বেশ চেচমেচি শুরু করতেই একজন শিবলি সাহেবের মুখের সামনে অস্ত্র ঠেকিয়ে ধরল। শোরগোল টের পেয়ে সবাই ছুটে এলো যার যার ঘর থেকে। স্ত্রী রেখা, মেয়ে রিয়া ভয়ে কাঁদতে শুরু করল। কেউ কেউ এগিয়ে গিয়ে তাদের মাথার কাছেও অস্ত্র ধরল। সবাই একেবার চুপ হয়ে গেল। ছেলে পিয়াসকে ডাকাতরা হাত-পা বেঁধে ফেলে রাখলো। দলের একজন সবাইকে হুকুম দিচ্ছিল আর বাকিরা সেই মতো কাজ করছিল। শিবলি সাহেবের পকেটের সেলফোনটা তখনও পকেটে। নেয়ার আগেই সবার চোখের আড়ালে কিছু একটা লিখছিলেন। সঙ্গে সঙ্গেই একটা গুলি তারপর সব শেষ। হাউমাউ করে কেঁদে উঠল রেখা ও রিয়া। তখনি মেয়ে ও স্ত্রী ওদের গুলিতে লুটিয়ে পড়ল।
সর্দার দলের লোকদের বলল, তোদের কিছু প্রয়োজন থাকলে নিয়ে নে তাড়াতাড়ি। হাতে একদমই সময় নেই।
পিয়াস ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে ছিল শুধু । মুখটা ওরা শক্ত করে বেঁধে রেখেছিল।যেন সব জ্ঞানবুদ্ধি লোপ পেয়ে গিয়েছিল ওর। অতি দ্রুত লোকগুলো আলমারি থেকে সামান্য টাকাপয়সা তুলে নিয়ে বের হয়েই দেখে বাড়ির চারদিক পুলিশে ঘেরা। টেক্সটা করেই ফেলেছিলেন শিবলি সাহেব। ওরা বুঝতেই পারেনি। বাকিদের পালাতে সাহায্য করে ধরা পড়ল সর্দার,শান্ত ডাকাত। দীর্ঘদিন যাকে নৃশংসভাবে মানুষ হত্যা ও লুন্ঠনের জন্য হন্যে হয়ে খুঁজছিল পুলিশ।
পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে শান্ত ডাকাত বলল, "আমার যা শাস্তি যা হয় দিয়ে দিন তো। বেশি কথা বলতে আমার ভাল লাগেনা। আমার যা করার করেছি।অনেক মানুষ হত্যা করেছি আমি। "
.... কিন্তু মানুষগুলোকে না মেরেও তো ধন-সম্পদ লুটতে পারতি?
.....কি করব আমি সম্পদ দিয়ে? কার জন্য নেব? কে আছে আমার? আমার একমাত্র মেয়েকে স্কুলে যাবার পথে তুলে নিয়ে গেল ওরা। কত খুঁজলাম, পুলিশের কাছে কত কেঁদে কেটে অনুরোধ করলাম ওকে ফিরিয়ে আনার জন্য কোন লাভ হল না। তিনদিন পরে তার লাশ পাওয়া গেল এক বিলে। বউ আমার মেয়ের শোকে নির্বাক হয়ে গেল। তাকেও আর বেশিদিন ধরে রাখতে পারলাম না। কি সুখের সংসার ছিল আমাদের! ছোট চাকরি করতাম, বেতন কম। বউ বড় মাছ খেতে চাইতো মাঝেমাঝে। কষ্ট করে যেদিন কিনতে পারতাম মনে খুব শান্তি লাগতো। মেয়ের পছন্দের মাংশ কিনতেও বেশ কষ্ট হত। তবুও আমি কত সুখী ছিলাম!
ওরা হারিয়ে যাবার পর কোনদিন কোন ভাল খাবার আমি খাইনি, একবারের জন্যও ইচ্ছে করেনি খেতে। চাকরিটাও আর করিনি। কিছুদিন ধরে একা একা থেকে একসময় নিজের ভিতর থেকে কে যেন প্রশ্ন করতে থাকল, "কি দোষ ছিল আমার? কেন এমন হল?"
ভাবলাম আমার মত নিরীহ মানুষের যদি সুখে থাকার অধিকার না থাকে, কাউকে সুখে থাকতে দেব না আমি। যতদিন বাঁচব, মানুষের সুখ নষ্ট করব। ধন-সম্পদ আমি নিইনা কারো থেকে, শুধু সুখটা ছিনিয়ে নিয়েই আমার শান্তি। আমার মত কষ্ট পাওয়ার জন্য ও কাউকে না কাউকে বাঁচিয়ে রাখি। আমার দলের লোকদের অনুমতি দিয়েছি, খেয়েপড়ে বেঁচে থাকার জন্য সামান্য কিছু নেয়ার। বলতে বলতে দুগাল বেয়ে অশ্রুধারা নামল শান্ত ডাকাতের।
পুলিশ অফিসার নিজের চোখদুটো মুছলেন রুমালে।
ফরিদা ইয়াসমীন নার্গিস
পিরোজপুর।

No comments

Powered by Blogger.