বাস্তবতা - নূরবানু রীনা
বাস্তবতা
নূরবানু রীনা
ম্যাডাম মনির কি আজ স্কুলে এসেছে? প্রধান শিক্ষকের জবাবে মেডাম বেলী বলেন,না মেডাম আসেনি। ওর বাবা গুরুতর অসুস্থ। আপনি গিয়েছিলেন ওর বাসায়?জী ম্যাডাম গিয়েছিলাম। ওর মা বলেছে, মনিরকে আর স্কুলে পাঠাবে না।
কেনো?
কারণ মনির ওর মায়ের সাথে কাজ করে যা রোজগার করে তাই দিয়ে ওদের পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট
সংসার চলে। ওর মায়ের কোলে পাঁচ মাস বয়সী একটি বোনও আছে।
প্রধান শিক্ষক উদ্বিগ্ন হয়ে বলে, এত খুব মুশকিলের কথা হলো। সামনে সমাপনী পরীক্ষা। এ অবস্থায় ক্লাস না করলে পরীক্ষা দিবে কেমন করে? এদিকে ডি,আর জমা দেওয়া হয়েছে।
ম্যাডাম বেলী বলে, আমিতো প্রায়ই যাই স্টুডেন্ট'সদের বাসায়। মনিরের মাকে অনেক বুঝিয়েছি। এখন সে আমাকে দেখলেই বিরক্তবোধ করে। ক্ষুধার্ত আর ভিষণ অসহায় একটি পরিবার। কারো মুখে হাসি নেই, শুকনো মুখ,কথা বললে উত্তর দিতে চায়না, কথা শুনছে কিনা তারও কোনো ভাবান্তর নেই ওর মায়ের মুখে। আপন মনে কাজ করে যায়। ওর মায়ের কাছে বর্তমান সময় পার করাটাই দুঃসাধ্য হয়ে উঠেছে, ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবার সুযোগ নেই।
দুদিন পর জানা গেলো, মনিরের বাবা স্ত্রী আর অসহায় সন্তানদের মুক্তি দিয়ে না ফেরার দেশে চলে গিয়েছে।
একদিন ম্যাডাম বেলীর সাথে দেখা হয় মনিরের। মাথাভর্তি উষ্কখুষ্ক রুক্ষ চুল, মুখে নেই শিশুসুলভ কমনীয়তা, চিন্তিত এক দিশেহারা গাম্ভীর্যের বয়স্ক বৃদ্ধ যেনো উদভ্রান্তের মত হেটে চলেছে। মেডাম বেলী বলে, মনির দাঁড়াও।স্কুলে আসনা কেন? মনির বলে, আমি আর পড়বো না।
ম্যাডাম বলে, পড়তে ভালো লাগেনা তোমার?
মনির বলে, লাগে। মা পাঠাবে না।
ম্যাডাম বলে মাকে বলো, তুমি পড়তে চাও। পড়াশুনা না করলে কোনোদিন উঠে দাঁড়াতে পারবে না। এভাবেই সারাজীবন কষ্ট করে যেতে হবে। খেতে পাবেনা, চিকিৎসা পাবেনা, পোশাক পাবেনা। পরীক্ষার আর মাত্র দুই মাস বাকী। তুমিতো লেখাপড়ায় ভালো। একটু ক্লাস করলেই ভালো রেজাল্ট করতে পারবে।
মনিরের মুখের কোনো পরিবর্তন হলো না। একই সুরে বলল, মায়ের কোলে বাচ্চা। আমি সাথে কাজ না করলে কাজ ওঠেনা। তখন বাড়ির সবাইকে না খেয়ে থাকতে হয়।
এভাবে সমাপনী পরীক্ষার আগের দিন পর্যন্ত শিক্ষকরা মনিরকে পরীক্ষায় অংশগ্রহণের জন্য চেষ্টা চালায়।কারণ মনির মেধাবী ছিল।
দারিদ্র্যের নির্মমতায় আমাদের দেশের হাজারো মনিরের মেধা বিকশিত হওয়ার সুযোগ পায়না। সরকারী অনুদান কোথা থেকে কোথায় হারিয়ে যায় এসব অসহায় পরিবার জানেনা। এরা সমাজের উচুমানের লোকদের দেখলে আড়ালে দাঁড়িয়ে চোখ কুঁচকে তাঁকিয়ে থাকে। ভাবে সবাই এক।
আমাদের দেশে জীবনের প্রতিটি বিষয় নিয়ে চমৎকার ভাবে লেখা যায়। বানিয়ে লিখতে হয়না। সবই গল্পের মত ঘটনা।
No comments